প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। —ফাইল চিত্র।
যদিও ‘রথ ভাবে আমি দেব, পথ ভাবে আমি’, কোন মন্ত্রে রাজনীতির চাকা কতটা ঘোরে জানেন অন্তর্যামী। কেন্দ্রীয় সরকারের নির্দেশ, রথযাত্রা করে সরকারি প্রকল্পের সাফল্যের প্রচার করতে হবে সরকারি আধিকারিকদের। ভারতীয় রাজনীতি জানে, ওই রথের চাকা চলবে ভারতের গণতন্ত্রের বুকের উপর দিয়ে। গোটা প্রশাসন ব্যবস্থাকে রাজনৈতিক প্রচারযন্ত্র করে তোলার দীর্ঘ দিনের পরিকল্পনা এ ভাবেই সুসম্পন্ন হয়ে চলেছে। আজ গণতন্ত্রের প্রধান প্রতিষ্ঠানগুলির কোনওটিরই স্বাতন্ত্র্য, স্বমর্যাদা আর অবশিষ্ট নেই। ‘সবই এক, একই সব’— এমন এক অলীক বিভ্রমকে সংশয়াতীত সত্য বলে প্রতিষ্ঠা যেন হয়েই গিয়েছে। সরকারি কর্মচারীদের ভোটপ্রার্থীর হয়ে কাজ করার কথা নয়, তাঁদের দায়বদ্ধতা ভোটদাতার প্রতি। সরকারি নীতি ও প্রকল্পের সার্থকতা-ব্যর্থতা নিয়ে ভোটদাতার প্রশ্নের উত্তর দেওয়াই তাঁদের কাজ। ভোটদাতা যাতে ভোটপ্রার্থীর মূল্যায়ন করতে পারেন, সে জন্য তথ্য জোগানো প্রশাসনের কর্তব্য। নরেন্দ্র মোদী সরকারের ‘রথপ্রভারী’দের প্রচারে পাঠানো মানে জনগণকে বুঝিয়ে দেওয়া: তথ্য-পরিসংখ্যানের চাহিদা, অন্যায় বঞ্চনার প্রতিকার, দুর্নীতির অভিযোগ পেশ করার সুযোগ নেই, কারণ, রথকে ঘিরে নাগরিকের সভা বসে না, ভক্তের সমাগম হয়। রথযাত্রা বিজেপির রাজনৈতিক প্রচারের বাহন। তিন দশক আগে অযোধ্যায় বাবরি মসজিদ ভাঙার উদ্দেশ্যে লালকৃষ্ণ আডবাণীর রথযাত্রা ভারত-মানসে যে ক্ষত তৈরি করেছিল, তার নিরাময় এখনও হয়নি। কেন্দ্রের কর্মচারীদের নিয়ে সরকারি রথগুলি যদি পথে বেরোয়, তার যাত্রাপথ হবে ভারতের সংবিধান-আধারিত প্রজাতান্ত্রিক, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার বিপরীতে।
বিজেপি সভাপতি জে পি নড্ডা বলেছেন, সরকারি প্রকল্পের সুবিধা যাতে সবাই পান, সে জন্য তার প্রচার তো সরকারি আধিকারিকদেরই কাজ। কথাটি একই সঙ্গে ভুল ও মিথ্যা। যুগ্ম সচিব, অধিকর্তা, উপ-অধিকর্তাদের কাজ গ্রামে গ্রামে প্রচার করা নয়। সরকারি প্রকল্পের প্রচারের জন্য জনসংযোগ বিভাগ রয়েছে কেন্দ্রে, রাজ্যেও। বাড়তি সুবিধে, রথে-বসা যাত্রীটি যদি হন সরকারি কর্তা, তা হলে রথের খরচও জোগাবে সরকার। রাজকোষের টাকায় রাজনীতির প্রচারের সুযোগ কে-ই বা ছাড়তে পারে? কৌতুকের বিষয় এই যে, রথে চড়ে সরকারি ‘সাফল্য’ প্রচার করার নির্দেশ সর্বপ্রথম দিয়েছে যে মন্ত্রকটি, তা হল কৃষি। ২০২২ সালের মধ্যে চাষির রোজগার দ্বিগুণ করার যে ঘোষণা মোদী করেছিলেন ২০১৬ সালে, তার পরিণতি কী হয়েছে, তা কারও অজানা নেই। কৃষকদের সংগঠিত প্রতিবাদে কৃষি আইনগুলি প্রত্যাহৃত। খাদ্যশস্যের উৎপাদন কমছে, খাদ্যের মূল্যস্ফীতি দরিদ্রের ক্রয়ক্ষমতা কমাচ্ছে। এই পরিস্থিতিতে কৃষি মন্ত্রকের ‘বিকশিত ভারত সঙ্কল্প যাত্রা’ একটি নিখাদ রাজনৈতিক কর্মসূচি।
বিরোধী দলগুলি সরকারি আধিকারিকদের প্রচারে পাঠানোর বিরুদ্ধে সরব বটে, তবে তাঁরাও কি একই কাজ করেন না? সরকারি প্রকল্পগুলি এখন সর্বত্র ক্ষমতাসীন দলের ভোটপ্রচারের মাধ্যম। এই জন্যই সরকারি প্রকল্পের উদ্দেশ্য-বিধেয় নিয়ে আলোচনার চাইতে সেগুলির নামকরণ নিয়ে বেশি শোরগোল বাধে। কেন্দ্রীয় সরকারের নির্ধারিত নাম না দিলে প্রকল্পের বরাদ্দই বন্ধ করে দেয় কেন্দ্র। কেন্দ্রীয় প্রকল্পের অনেকগুলির নামের গোড়াতেই রয়েছে ‘প্রধানমন্ত্রী’ শব্দটি। ফলে প্রকল্পের প্রচার করলে প্রধানমন্ত্রীর প্রচার হতেই হয়। তবে কিনা, “বরাবর সংসার যারা চালায়, রথের রশি তাদেরই হাতে,” রবীন্দ্রনাথের রথের রশি নাটকে পুরোহিত যখন এ কথা বলেছিলেন, তিনি জানতেন না শেষ অবধি কার টানে রথ চলবে। ভাবতে ইচ্ছা করে, এ কালেও রথের যাত্রার ভবিতব্য বলা সহজ নয়, রথযাত্রার জন-আবেদনও চিরন্তন নয়। নির্বাচন কমিশন ইতিমধ্যেই ভোটমুখী রাজ্যগুলিতে এই যাত্রায় নিষেধাজ্ঞা জারি করেছে। অন্যত্রও আগামী রথযাত্রার সাফল্য কতখানি, দেখা যাক।