ছবিঃ পিটিআই।
জোট রাজনীতির এমনই মহিমা যে, অন্ধ্রপ্রদেশও ‘পূর্ব ভারত’-এর আওতায় চলে এল! নির্মলা সীতারামন যে ‘ঐতিহাসিক’ বাজেটটি পেশ করলেন, তাঁর মহিমা যদি কোথাও থাকে, তবে তা এই ভূগোলের পুনর্নির্মাণে। নীতীশ কুমার ও চন্দ্রবাবু নায়ডু তাঁদের সমর্থনের দাম যে কড়ায়-গন্ডায় বুঝে নিচ্ছেন এবং নেবেন, এই বাজেটে সে কথা স্পষ্ট। সত্য বলতে, শুধু সেটুকুই স্পষ্ট। বাকি বাজেট বক্তৃতাটি— ভারতের বাজেট বক্তৃতার ঐতিহ্য মেনেই— অস্পষ্ট। নিতান্ত অবান্তরও বটে। কর্মসংস্থান নিয়ে অনেকগুলি কথা খরচ করলেন অর্থমন্ত্রী। যেমন, যাঁরা নতুন চাকরিতে ঢুকবেন, তাঁদের এক মাসের বেতন দেবে কেন্দ্রীয় সরকার। অথবা, দেশের শীর্ষ পাঁচশোটি বেসরকারি সংস্থাকে আগামী পাঁচ বছরে মোট এক কোটি ইন্টার্ন বা শিক্ষানবিশ নিয়োগ করতে হবে, তাঁদের মাসে পাঁচ হাজার টাকা ভাতা দিতে হবে। অর্থমন্ত্রী জানিয়েছেন, এই ভাতার টাকা আসবে সংস্থাগুলির কর্পোরেট সোশ্যাল রেসপন্সিবিলিটি-র তহবিল থেকে। অনুমান করা চলে, এই পরস্মৈপদী কর্মসংস্থানের কথাটি প্রধানমন্ত্রী বিভিন্ন বক্তৃতায় ফলাও করে বলবেন। জানাবেন, কত নতুন চাকরির ব্যবস্থা হল তাঁর সরকারের আমলে। ‘শিক্ষানবিশি’ শেষ হলে এই ছেলেমেয়েগুলির কী হবে, সে সংবাদ অবশ্য প্রধানমন্ত্রীর ভাষণে পাওয়া যাবে না। যেমন জানা যাবে না যে, সরকার যাঁদের প্রথম মাসের বেতন দিল, তাঁরা আর কত মাস বেতন পেলেন।
অর্থমন্ত্রীর বক্তৃতায় যে প্রসঙ্গগুলি কার্যত এলই না, অমৃতকালের যাত্রায় সেগুলির গুরুত্ব বিপুল। যেমন, রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাগুলির বিলগ্নিকরণের প্রসঙ্গ। এখন বহু রাষ্ট্রায়ত্ত সংস্থাই লাভজনক হয়ে উঠেছে। ঠিক সেই কারণে এখন সংস্থাগুলির বিলগ্নিকরণের সেরা সময়— সবচেয়ে বেশি দাম পাওয়া যাবে এখনই। সরকার সে পথে হাঁটল না। উন্নয়নখাতে সরকারি ঔদাসীন্যও স্পষ্ট। স্বাস্থ্য এবং পুষ্টির খাতে কেন্দ্র যা বরাদ্দ করেছে, তাতে ‘বিকশিত ভারত’-এর আশ্বাস ফিকে লাগতে পারে। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ খাতের মোট বরাদ্দ টাকার অঙ্কে সামান্য বাড়লেও মূল্যস্ফীতি হিসাবে ধরলে কার্যত তিন শতাংশ কমছে। প্রধানমন্ত্রী স্বাস্থ্য সুরক্ষা যোজনায় বরাদ্দ কমেছে প্রায় এক হাজার কোটি টাকা (৩৩৬৫ কোটি টাকা থেকে ২২০০ কোটি টাকা)। কোভিডের পরে সংক্রামক ব্যাধি প্রতিরোধের উন্নত পরিকাঠামো নির্মাণ, জাতীয় ডিজিটাল স্বাস্থ্য মিশন, আপৎকালীন চিকিৎসা-সহ নানা খাতে পরিকাঠামো তৈরির বরাদ্দ কমেছে। পুষ্টির অন্যতম প্রধান প্রকল্প— সক্ষম অঙ্গনওয়াড়ি এবং পোষণ ২— খাতে টাকা বরাদ্দ গত বাজেটে ঘোষিত বরাদ্দের চেয়ে সামান্য বেশি, কিন্তু সংশোধিত বরাদ্দ, অর্থাৎ প্রকৃত ব্যয়ের চেয়ে প্রায় তিনশো কোটি টাকা কম।
সরকার গঠনের পর প্রথম বাজেটটির দিকে পর্যবেক্ষকরা আগ্রহভরে চেয়ে থাকেন, কারণ এই বাজেটই সাহসী পদক্ষেপ করার, নতুন ভাবে ভাবতে চেষ্টা করার প্রকৃষ্টতম সময়। এই বাজেটে সরকারের পরবর্তী পাঁচ বছরের পথনির্দেশ পাওয়ার আশা থাকে। নির্মলা সীতারামনের ‘ঐতিহাসিক বাজেট’ সে কাজে সম্পূর্ণ ব্যর্থ। অবশ্য, নির্মলাকে দোষ দেওয়ার সম্ভবত অর্থ হয় না— বাজেটটি তাঁর নেতৃত্বে রচিত হয়, তিনিই তা পাঠ করেন সংসদে, কিন্তু সরকারের আর পাঁচটা জিনিসের মতো বাজেটও সম্ভবত প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর ‘মন কি বাত’। এই বাজেট বলে দিচ্ছে, তাঁর ঝুলিতে সম্ভবত নতুন কিছু নেই। জোট রাজনীতির বাধ্যবাধকতা আছে; যে সব কারণে লোকসভা ভোটে বিজেপির গায়ে ধাক্কা লেগেছে, সেগুলিকে মেরামত করার দায় আছে— অন্তত সেই চেষ্টা করছেন, সেটুকু দেখাতে হবে। সে কারণেই কর্মসংস্থানের ঘন ঘন উল্লেখ। আর আছে অমৃতকালের কুমিরছানা। বাজেট বক্তৃতাটি সেই সব সমীকরণেরই লিখিত ও পঠিত রূপ। বক্তৃতাটিকে অনতিদীর্ঘ রেখেছেন, সে জন্য অর্থমন্ত্রী ধন্যবাদার্হ।