—ফাইল চিত্র।
হাতির সঙ্গে মানুষের সহাবস্থান কোথায় এবং কতখানি সম্ভব, তা নিয়ে বিস্তর মতানৈক্যের সুযোগ আছে। লক্ষ করার মতো বিষয়, কেবল সংবাদমাধ্যমের এবং সরকারি দফতরে নয়, সাহিত্যেও হাতি নিয়ে যত মত তত পথ। লীলা মজুমদারের মতো সাহিত্যিক, যিনি বড় হয়েছেন অতি হাতি-অধ্যুষিত অঞ্চলে, তাঁর ভান্ডারেও মিষ্টি হাতি ‘কুসুমকলি’র পাশেই রয়েছে ভয়ানক রাগী হাতি ‘যাত্রামঙ্গল’-এর কথা। প্রভাতকুমার মুখোপাধ্যায়ের গল্পে ‘আদরিণী’ হাতি যেমন ভালবাসার আবেগে পরিবারের এক জন হয়ে যায়, ঠিক তেমনই অতীতে ও বর্তমানে এ-হেন দৃষ্টান্তের অভাব নেই যেখানে হাতির দাপটে বাড়িঘর ভেঙে পড়ে, পরিবার পথে বসে। এই ভাবেই ভয়-ভালবাসার দ্বৈত সম্পর্কে বাঁধা মানুষজীবন ও হাতিজীবন, পশ্চিমবঙ্গ প্রায় নিয়মিত ভাবে তার সাক্ষী। এই রাজ্যের পশ্চিমে ও উত্তরের বনাঞ্চলের সীমানা জুড়ে যেখানেই মনুষ্যবসতি, সেখানেই হাতির আচমকা আনাগোনা প্রাত্যহিক আতঙ্ক তৈরি করে রাখে। ফলে ‘হাতি করিডর’কে যেমন অবজ্ঞা ও উপেক্ষা করে রেললাইন বানানো, রিসর্ট বসানো হয়, তেমনই যতই মানুষ বনভূমি-পরিবৃত বাসাঞ্চলে যথাবিধি নিরাপদে থাকার প্রয়াস করে, দেখা যায় তাদের নিরাপদরেখা পার করে ঢুকে আসছে হাতির দল, গোলযোগের একশেষ করছে। বিশেষজ্ঞরা এও বলছেন যে, মানুষের খাদ্যাভ্যাস যেমন পাল্টাচ্ছে, হাতির ক্ষেত্রেও দৈনন্দিনতায় পরিবর্তন ঘটছে। খাদ্যশস্যে তৃপ্ত না হয়ে তারা মুখরোচক রন্ধনকৃত খাদ্যদ্রব্যের সন্ধান করছে— ভাত-তরকারির অনাস্বাদিতপূর্ব বিলাস কোনও কোনও অঞ্চলে হাতিজীবনের প্রত্যাশাই পাল্টে দিতে বসেছে।
এই পরিবর্তনশীল মিথোজীবিতার পরিপ্রেক্ষিতে সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গে একটি বড় সুসংবাদ। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স বা এআই-নির্ভর ট্র্যাপ-ক্যামেরার সাহায্যে হাতিদের চলাচলের উপর নজর রাখা এবং সময় বুঝে নিকটস্থ বাসিন্দাদের সতর্ক করতে ‘অ্যালার্ট’ জারি করার ব্যবস্থা হয়েছে প্রযুক্তির ব্যবহারে। এবং ঝাড়গ্রাম, লোধাশুলি, মানিকপাড়া ও গিধনি অঞ্চলের বিভিন্ন জায়গায় গত অক্টোবর মাস থেকে এপ্রিল অবধি ‘পাইলট প্রোজেক্ট’ চালিয়ে এই ব্যবস্থাটি সফল ও সুফলদায়ী বলে প্রমাণিতও হয়েছে ইতিমধ্যে। হাতির চলাচলের সঙ্গে তাল রেখে অ্যালার্ট জারি করা মাত্র বাসিন্দারা প্রয়োজনীয় সতর্কতা নিতে পেরেছেন, এবং তদ্দ্বারা অনেক সম্ভাব্য ক্ষয়ক্ষতিও এড়ানো গিয়েছে। খুবই দক্ষ ভাবে, মানুষ ও অন্যান্য পশুর চলাচলকে সরিয়ে রেখে কেবল হাতির চলাচল বিষয়ে এমন অ্যালার্ট জারি করা যে কোনও প্রযুক্তির পক্ষেই একটি বড় ধাপ। এআই যে কেবল মানবজীবন বিপর্যস্ত করতেই উদ্যত, তা নয়, মানবকল্যাণেও তার বিশেষ ভূমিকা থাকতে পারে, হাতি-সৌজন্যে সেই সত্য প্রতিষ্ঠিত হল। তবে স্বাভাবিক ভাবেই এই প্রযুক্তিটি ব্যয়সাপেক্ষ হওয়ায় কতটা ব্যাপক ভাবে এর ব্যবহার সম্ভব, তা এখনও স্পষ্ট নয়। প্রশাসনের কাছে এ এক বড় সুযোগ। পশুজীবনে কোনও ব্যাঘাত সৃষ্টি না করে মানুষকে নিরাপত্তা দেওয়ার এই পদ্ধতি সামগ্রিক পরিবেশের পক্ষে কল্যাণকর। এবং প্রশাসনের পক্ষেই সম্ভব, খরচের ব্যবস্থা করে এই এআই অ্যালার্ট বিস্তীর্ণ স্থানে ছড়িয়ে দেওয়া। সফল মিথোজীবিতার একটি বড় শর্ত, পরস্পরের দুনিয়ায় কেবল সীমিত ভাবে হস্তক্ষেপ বা পদচারণ করা। হয়তো মানুষ ও পশুকে সেই শর্তে বেঁধে রাখতে পারবে প্রযুক্তির উপযুক্ত ব্যবহার।