যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়। —ফাইল চিত্র।
একটি মর্মান্তিক মৃত্যুর সূত্র ধরে যে ভয়াবহ ব্যাধির স্বরূপ উন্মোচিত হয়েছে, তার নিরাময়ের জন্য প্রয়োজন যথাযথ চিকিৎসা, পরিচর্যা ও শুশ্রূষা। তার দায় কেবল তার ছাত্র-ছাত্রী শিক্ষক-শিক্ষিকা এবং পরিচালকদের নয়, গোটা সমাজেরই। পশ্চিমবঙ্গের গর্ব করার মতো সামগ্রী আর খুব বেশি অবশিষ্ট নেই, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় অবশ্যই তাদের অন্যতম, বিদ্যাচর্চার বিভিন্ন মাপকাঠিতেই তার স্থান দেশের মধ্যে প্রথম সারিতে। পরিকাঠামো এবং সংসাধনের বহু অভাবের মধ্যে বিস্তর লড়াই করে উৎকর্ষের এই মান তাকে রক্ষা করতে হয়েছে, যে অভাবের পিছনে কেন্দ্রীয় সরকারের দায় বিপুল, রাজ্য সরকারের দায়িত্বও কম নয়। এই পরিপ্রেক্ষিতেই বিশেষ আবশ্যক ছিল হাল ফেরানোর এক সর্বাত্মক প্রয়াস। বিপর্যয়ের অভিঘাতে সম্বিৎ ফিরে পেয়ে সংশ্লিষ্ট সমস্ত পক্ষ সেই প্রয়াসের শরিক হবেন এবং রাজ্যের স্বার্থে রাজনীতিকরা সব ক্ষুদ্রস্বার্থ সরিয়ে রেখে সমবেত ভাবে তাতে সহযোগিতা করবেন, এমনটাই কাম্য ছিল।
কিন্তু বাস্তব চিত্রটি তার সম্পূর্ণ বিপরীত। ৯ অগস্টের ঘটনার ‘সুযোগ’ নিয়ে কার্যত প্রথম দিন থেকে দলীয় রাজনীতির উৎকট লড়াই চলছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক এবং ‘অরাজনৈতিক’ ছাত্র সংগঠনের অনন্ত রেষারেষিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসরটি আক্ষরিক অর্থেই রণভূমিতে পরিণত, আঠারো দিনেও তার অবসানের ভরসা নেই। এই পরিস্থিতিতে যাঁদের দায়িত্বশীল অভিভাবকের ভূমিকা পালন করার কথা ছিল, তাঁদের আচরণে দেখা গিয়েছে দায়িত্বজ্ঞানহীন সঙ্কীর্ণ দলীয় রাজনীতির কদর্য রূপ, যা কেবল দুর্ভাগ্যজনক নয়, লজ্জাকর। একেবারে প্রথম পর্বেই রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করেছেন, যাদবপুর এখন ‘আতঙ্কপুর’। রাজ্যের মুখ্য প্রশাসক একটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে এমন অভিধায় নিন্দিত করতে পারেন! শুধু তা-ই নয়, তদন্ত প্রক্রিয়ার তোয়াক্কা না করে— এবং পারিপার্শ্বিক সাক্ষ্যপ্রমাণকে সম্পূর্ণ তুচ্ছ করে— তিনি এই ঘটনার জন্য ‘কিছু আগমার্কা সিপিএম’কে দোষী বলে রায় ঘোষণা করে দিয়েছেন! উল্টো দিকে, রাজ্য বিধানসভার প্রধান বিরোধী দলনেতা যাদবপুরে হাজির হয়েছেন এবং ধর্না-মঞ্চে দাঁড়িয়ে ‘তুলে ফেলে দেব’, ‘উপড়ে ফেলব’, হিসেব বুঝে নেব’ ইত্যাদি মহান বাণী সম্প্রচার করে জানিয়ে দিয়েছেন যে, জেএনইউতে ‘টুকড়ে টুকড়ে গ্যাং’কে যে ভাবে তুলে ফেলে দেওয়া হয়েছে, যাদবপুরেও সেই প্রক্রিয়া বলবৎ হবে! স্পষ্টতই, শাসক এবং বিরোধী, দুই তরফের শীর্ষস্থানীয় নায়কনায়িকারা বিশ্ববিদ্যালয় তথা পশ্চিমবঙ্গের সুস্বাস্থ্য নিয়ে চিন্তিত নন, তাঁরা একটি খেলাই খেলতে জানেন।
এই সর্বগ্রাসী ক্ষমতাতন্ত্রের বিপদ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়কে যদি রক্ষা করতে হয়, তবে তার বড় দায়িত্ব নিতে হবে শুভবুদ্ধিসম্পন্ন শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের। দলীয় রাজনীতির ঘেরাটোপে নয়, অরাজনৈতিক নামাবলির আড়ালেও নয়, যথার্থ গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই সেই দায়িত্ব পালন করা সম্ভব। তার জন্য কোনও মহামিলনের স্বপ্ন রচনার প্রয়োজন নেই, বরং স্বাভাবিক মতানৈক্য সঙ্গে রেখে পারস্পরিক সংলাপ ও যৌথ অনুশীলনের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হলেই সেই অগ্রগতি স্থায়ী হতে পারে। বিশ্ববিদ্যালয়ের পঠনপাঠন, গবেষণা এবং সামগ্রিক পরিবেশ কী ভাবে স্বাস্থ্যবান হতে পারে, সেটাই এই অনুশীলনের লক্ষ্য। সেই উদ্দেশ্যে এক দিকে যেমন ক্ষমতার অধীশ্বরদের উপর সমস্ত প্রয়োজনীয় সহযোগিতার জন্য চাপ দেওয়া দরকার, অন্য দিকে প্রতিষ্ঠানের অভ্যন্তরীণ প্রশাসন এবং পরিবেশের সংস্কারও নিশ্চিত করা দরকার। দু’টি কাজ একমাত্র পরস্পরের সহায়তাতেই বাস্তবায়িত হতে পারে। পশ্চিমবঙ্গে ক্ষমতাসর্বস্ব দলীয় রাজনীতি এবং তার প্রতাপ-অন্ধ কারবারিদের থেকে প্রতিষ্ঠানগুলিকে রক্ষা করার প্রশ্নটি এখন প্রায় শেষরক্ষার প্রশ্ন। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয় তার উত্তর সন্ধানের পরিসর হয়ে উঠতে পারবে কি?