—প্রতীকী চিত্র।
উত্তরপ্রদেশের মুজফ্ফরনগরের পাবলিক স্কুলের প্রধান শিক্ষিকা তৃপ্তা ত্যাগী আত্মপক্ষ সমর্থনে জানিয়েছেন, তিনি মোটেই হিন্দু-মুসলমান ভেদাভেদ করেননি, তাঁর কথা বিকৃত করে দেখানো হয়েছে যে, তিনি হিন্দু সহপাঠীদের ডেকে ডেকে এক মুসলমান ছাত্রকে প্রহার করতে বলছেন। এমন সাফাই শুনে আতঙ্কিত হতে হয়। এক বালক ক্লাসঘরের এক কোণে দাঁড়িয়ে আছে, তার সহপাঠীরা একে একে এসে তার গালে চড় কষিয়ে যাচ্ছে, দূরে বসে শিক্ষিকা তাদের আরও জোরে চড় মারতে আদেশ দিচ্ছেন— সমাজমাধ্যমে বহুলপ্রচারিত ভিডিয়ো-চিত্রে এমন ভয়ঙ্কর রকমের অন্যায়ের কাহিনি উন্মোচিত হলে শিক্ষিকা নিজে যারপরনাই লজ্জিত ও অনুতপ্ত হয়ে সকলের কাছে, বিশেষত ওই ছাত্রের কাছে নিঃশর্ত ক্ষমা চাইবেন এবং জীবনে কখনও এমন অপরাধ না করার প্রতিশ্রুতি দেবেন, সভ্য সমাজে এটাই স্বাভাবিক, বিশেষত সেই শিক্ষিকা যদি আবার স্কুলের প্রধান হন! কিন্তু অভিযুক্ত শিক্ষিকাটি অম্লানবদনে জানিয়েছেন, তিনি শারীরিক ভাবে প্রতিবন্ধী, তাই ওই বালককে ‘পড়া তৈরি না করার’ জন্য প্রাপ্য শাস্তি দিতে বলেছেন অন্য ছাত্রদের। তাঁর মতে, এই শাস্তি ওই ছাত্রটির তথা সমস্ত অমনোযোগী ছাত্রের ভালর জন্যই, তাদের অভিভাবকরাও এমনটাই চান! অভিভাবকদের মতে শিক্ষক চলবেন কেন, সেটা একটা প্রশ্ন হতে পারে। আজকের পৃথিবীতে শিশুদের দৈহিক শাস্তি দেওয়া যে অপরাধের শামিল, তা তিনি জানেন না কেন, এটা হতে পারে পরবর্তী প্রশ্ন। আর, এমন গর্হিত অপকর্ম ছাত্রদের দিয়ে করানো যে দ্বিগুণ অপরাধ, সেই সত্য বুঝবার সামর্থ্যও তাঁর থাকবে না কেন, এটি তৃতীয় প্রশ্ন। তবে কোনও প্রশ্নেরই উত্তর অজানা নয়। আজও এমন বোধহীন সংবেদনহীন শিক্ষকশিক্ষিকা (এবং অভিভাবক) দেশময় পরিব্যাপ্ত।
অবশ্যই, এই ঘটনায় সাম্প্রদায়িকতার প্রশ্নটি যে ভাবে জড়িয়ে গিয়েছে, তার পিছনে স্থানকালপাত্রের ভূমিকা সুস্পষ্ট। প্রথমত, কৃতকর্মের সাফাই গাইতে গিয়ে শিক্ষিকা বলেছেন, তিনি মুসলমান জননীদের উদ্দেশে উপদেশ দিচ্ছিলেন যে সন্তানের পরীক্ষার আগে তাঁরা যেন বাপের বাড়ি না যান, তাতে তাদের পড়াশোনার ক্ষতি হয়, সেই কথা থেকে ‘মুসলমান’ শব্দটি তুলে নিয়ে নাকি তাঁকে সাম্প্রদায়িক বলে প্রতিপন্ন করা হচ্ছে! এমন উপদেশ দেওয়ার জন্য যে শিক্ষিকাকে ছাত্র বা তার জননীর ধর্মপরিচয় দাগিয়ে দিতে হয়, তাঁর ‘অ-সাম্প্রদায়িকতা’র দাবি এতটাই ঠুনকো যে তাঁর কথা বিকৃত করার অভিযোগের বিশ্বাসযোগ্যতা নিয়েও গভীর সংশয় দেখা দিতে বাধ্য। এই মানসিকতাটি সাম্প্রদায়িক ভেদভাব এবং বিদ্বেষে আকীর্ণ সমাজ-মানসেরই প্রতিচ্ছবি। ঘটনাটি যে মুজফ্ফরনগরে ঘটেছে, তার তাৎপর্যও অনস্বীকার্য। গত এক দশকে এই অঞ্চল হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির পরীক্ষাগারে পরিণত হয়েছে। বস্তুত, যোগী আদিত্যনাথ শাসিত উত্তরপ্রদেশ রাজ্যটিতেই আগ্রাসী সংখ্যাগুরুতন্ত্র উৎকট আকার ধারণ করেছে। নিছক সামাজিক আস্ফালন নয়, রাজ্য প্রশাসনের বুলডোজ়ারও স্লোগান থেকে রাস্তায় নেমে এসেছে, সংখ্যালঘু অধিবাসীরাই যার শিকার। তাঁদের উপর সমাজজীবনের নানা স্তরে প্রত্যক্ষ নিপীড়নের পাশাপাশি জারি রয়েছে ভয় দেখানোর বিস্তীর্ণ আয়োজন, যার চাপে সংখ্যালঘু মানুষকে মাথা নিচু করে সতত ভয়ে সিঁটিয়ে থেকে কার্যত অর্ধমানবের জীবনযাপন করতে হচ্ছে। এমন পরিবেশে শিক্ষিকার নির্দেশে একটি মুসলমান ছাত্রকে তার সহপাঠীদের একে একে চড় মেরে যাওয়ার দৃশ্য কী অর্থ বহন করে, তা শিক্ষিকা বুঝেছেন, এবং বুঝেই যা করার করেছেন, এমন ধরে নেওয়া যায়। তাঁর বিরুদ্ধে স্থানীয় প্রশাসন প্রাথমিক নালিশ ইত্যাদির ব্যবস্থা করেছে। কিন্তু তার কতটা লোকদেখানো, আর কতটুকু সদিচ্ছাপ্রসূত? আরও বড় প্রশ্ন, বিদ্বেষের বাতাবরণ কতখানি পরিব্যাপ্ত হলে এমন দৃশ্যের জন্ম হতে পারে?