বন্দুকধারী এই ব্যক্তিকে আটক করে পুলিশ। নিজস্ব চিত্র।
পশ্চিমবঙ্গের স্কুলগুলির অবস্থা এখনও আমেরিকার মতো হয়ে যায়নি, নিঃসন্দেহে। এখানে এখনও স্কুল-চত্বরে দিনেদুপুরে বন্দুকবাজের হানায় যথেচ্ছ গুলি চলেনি, অসহায় স্কুলপড়ুয়াদের আহত, নিহত দেহের সারি প্রত্যক্ষ করতে হয়নি। কিন্তু, মালদহের স্কুলে সম্প্রতি যা ঘটল, স্কুল চলার মাঝেই যে ভাবে আগ্নেয়াস্ত্র, বিস্ফোরক নিয়ে এক জন শ্রেণিকক্ষে ঢুকে পড়লেন, তার নজিরও এই বাংলায় ইতিপূর্বে দেখা গিয়েছে কি? দেখা অবশ্য তাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা ভেবে উপেক্ষা করা চলে না। বরং, এই ধরনের ঘটনা এক অশুভ ইঙ্গিত বহন করে আনে, যা সার্বিক ভাবে পড়ুয়াদের নিরাপত্তা নিয়ে গভীর উদ্বেগের জন্ম দেয়।
স্বস্তির কথা, প্রশাসন এই জাতীয় ঘটনাকে যথোচিত গুরুত্ব দিয়েই দেখেছে। মালদহের ঘটনা-পরবর্তীতে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় স্কুলগুলিতে নিরাপত্তারক্ষী রাখার প্রস্তাব দিয়েছেন। প্রয়োজনে পুলিশের সাহায্য নেওয়ার কথাও জানিয়েছেন। কিন্তু, এই রাজ্যে যত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আছে, তাদের সকলের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে পুলিশকেই আসরে নামতে হবে, এমনটা কিঞ্চিৎ কষ্টকল্পিত। আবার এ কথাও ঠিক, পারিবারিক, ব্যক্তিগত, রাজনৈতিক-সহ নানাবিধ কারণে আক্রমণের লক্ষ্য যদি বিদ্যালয় প্রাঙ্গণ হয়ে দাঁড়ায়, এবং পড়ুয়াদের কখনও বন্দি করে, কখনও প্রহার করে নিজ স্বার্থসিদ্ধির মতো অশুভ বুদ্ধির উদয় হয় সমাজে, তবে ভবিষ্যতে বিদ্যালয়ের নিরাপত্তাব্যবস্থা নিয়ে নতুন করে ভাবা জরুরি হয়ে পড়ে। মালদহের ঘটনার অব্যবহিত পরেই পুরুলিয়ার কোটশিলার একটি স্কুলে কিছু পড়ুয়ার মধ্যে কথা কাটাকাটিকে কেন্দ্র করে কয়েক জন অস্ত্র নিয়ে স্কুলে হামলা করল। কিছু পড়ুয়াকে মারধরও করা হল। কয়েক মাস আগেও ব্যক্তিগত আক্রোশ থেকে ‘ভয় দেখাতে’ উত্তর ২৪ পরগনার এক স্কুলে বোমাবাজি করেছিল স্কুলেরই প্রাক্তন ছাত্র। পরিপ্রেক্ষিতের দিক থেকে বিচার করলে এই ঘটনাগুলি সম্পূর্ণ আলাদা। কিন্তু একটি বার্তা এগুলি থেকে স্পষ্ট— শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে যাবতীয় আক্রোশ, হানাহানি, ভেদাভেদ থেকে মুক্ত পবিত্র শিক্ষার পীঠস্থান মনে করার দিন বিগতপ্রায়। নিরাপত্তা নিয়ে নতুন করে ভাবার প্রয়োজন এইখানেই।
মালদহের ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রসঙ্গের উত্থাপন করেছেন মুখ্যমন্ত্রী— পরিচয়পত্র ছাড়া ওই ব্যক্তি স্কুলে ঢুকলেন কী করে? প্রসঙ্গটি যথার্থ। কিন্তু এটাও ঠিক যে, এই রাজ্যের প্রত্যন্ত অঞ্চলের বহু স্কুল জীর্ণ পরিকাঠামো নিয়ে ধুঁকছে। সেখানে বিদ্যালয়ের সঙ্গে যুক্ত সকলের পরিচয়পত্র থাকবে, এবং তার সদ্ব্যবহার হবে, এমনটা ভাবা কষ্টকর। তদুপরি, গ্রামের অনেক স্কুলে অস্থায়ী বেড়াটুকুও নেই। যেখানে রয়েছে, সেখানে আলাদা করে দারোয়ান রাখার সামর্থ্য আর্থিক অনটনে জেরবার স্কুলগুলির থাকে না। বহু স্কুলে অশিক্ষক কর্মচারীদের পদ শূন্য। বিদ্যালয়ের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে প্রশাসনকে এই ন্যূনতম প্রয়োজনগুলি সর্বাগ্রে মেটাতে হবে। সীমানা নির্দেশক বেড়া বা পাঁচিল নির্মাণ, সহায়ক কর্মী নিয়োগ, পরিচয়পত্রের সঠিক ব্যবহার অনেকাংশে নিরাপত্তার ফাঁক বুজিয়ে দিতে সক্ষম। পুলিশি প্রহরার প্রয়োজন সেখানে পড়ে না। বরং এক সামাজিক নজরদারি এবং শিক্ষক, শিক্ষাকর্মী ও শিক্ষার্থীর পারস্পরিক বন্ধনের মধ্যে দিয়ে বিদ্যালয়ের পরিবেশটি নিরাপদ হয়ে উঠতে পারে।