—প্রতীকী চিত্র।
পুজোর ছুটি— এমন আনন্দময় কথা আর কী-ই বা আছে। তবে তার কতখানি পুজোর আনন্দ, আর কতটা ছুটির, সে ধন্দ কাটার নয়। সবাই ছুটি পেলে খুশি হয়, এমন অবশ্য
নয়। এক দিনের জন্যেও ‘ধনার্জয়ধ্বম্’ মন্ত্রের ছন্দ থেকে বিচ্যুতি যারা ভয়ানক চটে যায়, ‘ছুটি’ শুনলেই তাদের ভুরুতে ঢেউ খেলে। ছুটির শুরু থেকেই তারা অপেক্ষায় থাকে, কবে শেষ হবে। ছুটির অপেক্ষায় যারা দিন কাটায়, তাদেরও অনেকের কাজের চাপ ভয়ানক বেড়ে যায়। বিদেশে একটি সমীক্ষায় দেখা গিয়েছিল, বেড়াতে যাওয়ার আগে মানসিক চাপ বা ‘স্ট্রেস’-এর মাত্রা হয়ে দাঁড়ায় গড়পড়তার বেশি। যাঁরা নিজের শহরেই ঠাকুর দেখবেন বলে কোমর বেঁধেছেন, তাঁদের ব্যস্ততার কাছে কাজের দিন তুচ্ছ— প্রবল ভিড়ে মণ্ডপে মণ্ডপে ভ্রমণ, বিশেষ জায়গায় ভোজন এবং গয়না-ব্যাগ-শিশুসন্তান সামলে ঘরে প্রত্যাগমন কম কথা নয়। সেই সঙ্গে প্রতিটি ইন্দ্রিয় অহরহ আপ্লুত হয় বাইরের বিচিত্র রং, রূপ, স্পর্শে। এই অস্থিরতা উপচে এসে পড়ে সন্তানদের জীবনেও। উৎসবের পক্ষ জুড়ে নানা ‘সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান’ চলে পাড়ায় পাড়ায়, যার অন্যতম কুশীলব শিশুরা। নিয়মিত মহড়া দিতে হয় তাদের। নদীর ধারে, খোলা মাঠের ধুলোয় লুটোপুটি করে ছুটি কাটানোর আনন্দ কেমন, তার আভাস শিশুরা কেবল গানের কথাতেই পায়। পাড়ার মঞ্চে অনুষ্ঠানের উত্তেজনা আছে, কিন্তু ফুরসত সেখানে নেই— ছুটির দিনেও চার-পাঁচ বছরের একটি শিশুকে তার দক্ষতার পরীক্ষা দিতে হয়। তার পরীক্ষার কক্ষটি ইস্কুলের ঘর থেকে মণ্ডপে সরে আসে কেবল। সমাজমাধ্যমে তাদের ছবির পোস্ট চাপের আরও একটি স্তর তৈরি করে, তাদের আরও সাবধানি, সতর্ক করে তোলে। ‘শিশু ভোলানাথ’ তখন কল্পনামাত্র।
‘ছুটি’ মাত্র দু’অক্ষরের শব্দ, তবু কী অপার সম্ভাবনা তার মধ্যে। সব প্রত্যাশার শাসন থেকে, দৈনন্দিনের প্রয়োজন থেকে মুক্তি যে ছুটি, তার ডাক শুনতে পাওয়ার সাহসই বা ক’জনের রয়েছে? বাইরে থেকে নানা কর্তব্যের চাপ যত আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখে, নিজের কাছে নিজের অবয়ব ততই স্পষ্ট বলে মনে হয়। হঠাৎ ছুটি মিললে তবেই নিজের অন্তরে ফাঁকফোকরগুলি স্পষ্ট হয়ে ওঠে। যা কিছু হওয়ার ছিল, করা হয়নি, যা কিছু পরিণতির অপেক্ষায়, সে সবই মুখের দিকে চেয়ে থাকে। তার মুখোমুখি হওয়া বড়ই কঠিন। সেই অস্বস্তি, সেই আত্মসংশয় এড়াতে সদাব্যস্ততার ভান করে সংসারী মানুষ।
এই প্রবণতাকেই বিদ্রুপ করে শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছিলেন, সংসারী ঈশ্বরচিন্তা এড়াতে চায় বলে অবসরে লেগে পড়ে ভাঙা বেড়া সারাতে। এমন অর্থহীন কাজে কত না ছুটি কেটে যায়। জীবনের যে সব অক্ষর বিনিসুতোর বন্ধনে গাঁথা হয় প্রত্যহ, সেগুলির অনিবার্য ইঙ্গিত থেকে মুখ ফেরাতে মানুষ কর্মহীন দিনগুলিকে প্রাণপণে ঠাসে নানা চমৎকার পরিকল্পনায়। মওকা বুঝে দিকে দিকে ফুর্তির বিপণন ফুলেফেঁপে ওঠে। কী না দেখা হয় ছুটির দিনে, নিজের সঙ্গে দেখা করা ছাড়া। যে সব চিন্তারাশি মনের কোণে জমা হয়ে থাকে, যে সব প্রশ্নেরা দিন গোনে মনের মনোযোগের আশায়, যত দুর্মূল্য উপলব্ধির ক্ষীণ ধারা অভ্যস্ত চিন্তার বালুরাশিতে পথ হারায়, সে সবই প্রত্যাশা করে থাকে ছুটির দিনের জন্য। জ্বর ছেড়ে যাওয়ার পর স্নানের মতো, যে দিনটি অকারণ দুশ্চিন্তার ক্লেদ ধুইয়ে মুক্ত করে মনকে, সেটাই ছুটির দিন। ক্যালেন্ডার বা পাঁজির পাতা মেনে সে ছুটি আসে না।