New farm bills

মুখোশনৃত্য

রাজনৈতিক বিতর্ক কেবল নেতাদের বচসায় পর্যবসিত হইলে সরকার তথা রাষ্ট্রের দায় সকলে ভুলিতে বসে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৪ অগস্ট ২০২১ ০৭:০০
Share:

পশ্চিমবঙ্গের কৃষককে গ্যালারির দর্শক করিয়া কেন্দ্র এবং রাজ্য ‘যুদ্ধ যুদ্ধ’ খেলায় মাতিয়াছে। দুইটি বড় নির্বাচন চলিয়া গেল, এখনও পরস্পর সহযোগিতায় দ্রুত কাজ করিবার লক্ষণ নাই। দুই পক্ষ পরস্পরের প্রতি কেবলই অভিযোগের কামান দাগিতেছে। সম্প্রতি রাজ্য অভিযোগ করিয়াছে, কেন্দ্রীয় সহায়তা প্রকল্প ‘পিএম কিসান’-এর জন্য রাজ্যের নয় লক্ষেরও অধিক আবেদন বাতিল হইতে বসিয়াছে কেন্দ্রীয় নানা দফতরের অসহযোগিতায়। ইহা এক দীর্ঘ চাপানউতোরের সাম্প্রতিক ধাপ। ইহার সূচনাপর্বে রাজ্য সরকার কেন্দ্রের প্রকল্পটি গ্রহণ করিতেই অসম্মত হইয়াছিল। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় দাবি করিয়াছিলেন যে, রাজ্যের নিজস্ব প্রকল্প ‘কৃষকবন্ধু’ বাংলার চাষিদের সহায়তায় আরও কার্যকর। কেন্দ্রের শাসক দল বিজেপি তৎক্ষণাৎ নির্বাচনী যুদ্ধে অস্ত্র করিল ‘চাষির বঞ্চনা’— ২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচন এবং ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে তাহার প্রচার চলিল। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বিধানসভা নির্বাচনের পূর্বে পশ্চিমবঙ্গের চাষিদের ‘পিএম কিসান’-এর আটটি কিস্তির বকেয়া টাকা দিবার প্রতিশ্রুতিও দিয়াছিলেন। এই বৎসরের গোড়ায় রাজ্য তাহার অবস্থান বদল করিয়া কেন্দ্রের প্রকল্পটি গ্রহণ করিতে সম্মত হইল। এই পর্বে রাজ্য তোপ দাগিল ‘কেন্দ্রের অসহযোগিতা’ লইয়া— রাজ্যের তালিকাভুক্ত চাষিদের নাম বাতিল করিতেছে কেন্দ্র, টাকা পাঠাইতে বিলম্ব করিতেছে। ফলে চলতি মাসে উত্তরপ্রদেশের দুই কোটিরও অধিক চাষি কেন্দ্রের সহায়তা পাইবেন, পশ্চিমবঙ্গে কেবল ছাব্বিশ লক্ষ চাষি তাহা পাইবেন। কেন্দ্রের পাল্টা অভিযোগ, পশ্চিমবঙ্গ বহু বিলম্বে তালিকা পাঠাইয়াছে বলিয়াই তালিকাভুক্ত চাষিদের তথ্য পরীক্ষা করিতে সময় লাগিতেছে। ইহাতে কেন্দ্রের কী দোষ?

Advertisement

পরস্পর দোষারোপ গণতন্ত্রে রাজনীতির অঙ্গ। এমনও আশা জাগিতে পারে যে, সরকারি প্রকল্পগুলি লইয়া নির্বাচনী প্রতিদ্বন্দ্বিতাই শেষ অবধি দারিদ্র নিরসন এবং আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে কার্যকর হইবে। অতএব কোন দল শ্রমিক-কৃষক, নারী-দলিত-প্রান্তবাসীর অধিক সহায়তা করিল, তাহা লইয়া রাজনৈতিক চাপানউতোর ক্লান্তিকর হইলেও অসার নহে। ইহা উন্নয়নের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। কিন্তু, ইহাকেই রাজনীতির সারাৎসার ধরিয়া লইলে বিপদ। কত দ্রুত কত চাষির নাম তালিকায় উঠিল— ইহাই কি আজ কৃষকের সমর্থন আদায়ের জন্য রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার একমাত্র বিষয়? ভারতের গণতন্ত্র কি এতই অকিঞ্চন হইয়াছে? যে বিষয়গুলিতে বাস্তবিক বিতর্ক প্রয়োজন, তাহাদের অনুল্লেখ অনেক বড় আশঙ্কার সূচনা করে। যেমন, অর্থসাহায্যের সুযোগ লইয়া কৃষক কতখানি লাভ করিতে পারেন, যদি পরীক্ষিত বীজ, পরিবেশ-বান্ধব সার-কীটনাশক, অথবা যথেষ্ট সেচের জল তাঁহার নাগালের বাহিরে থাকে? যদি ফসল সংরক্ষণ ও বিপণনের আধুনিক উপায় প্রস্তুত না হইয়া থাকে?

চাষি কত অনুদান পাইলেন, তাহার উত্তরে কৃষিসঙ্কটের সমাধান নাই। কৃষি যাহাতে লাভজনক হইতে পারে, তাহার ব্যবস্থা করাই সরকারের কর্তব্য। তাহার জন্য বহু কাজ বাকি। কৃষক অনুদান, সারে ভর্তুকি অথবা বিমার প্রিমিয়াম দান— সকলই নিষ্ফল হইবে যদি কৃষক বাজার ধরিতে না পারেন। আজ কেন্দ্র-রাজ্য রাজনৈতিক যুদ্ধ দেখিলে মনে হয়, বুঝি প্রকল্পের সহায়তা ভিন্ন চাষির পাইবার কিছু নাই। নেতাদের অভিযোগের তোপে দেশবাসীর কানে তালা লাগিয়া যায়, তখন চাষির স্বনির্ভরতার দাবি শুনিবে কে? রাজনৈতিক বিতর্ক কেবল নেতাদের বচসায় পর্যবসিত হইলে সরকার তথা রাষ্ট্রের দায় সকলে ভুলিতে বসে। মনে রাখিবার দায়টি এখন নাগরিক সমাজের উপর বর্তাইয়াছে। ফাঁক পাইলেই প্রশ্ন করা প্রয়োজন, ‘চাষিটিকে দেখিয়াছেন কি?’

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement