গ্রাফিক— শৌভিক দেবনাথ।
কলিকাতা পুরসভার নির্বাচনে কাহারা জয়ী হইবে, সেই প্রশ্নে সংশয় বা জল্পনার অবকাশ ছিল না। বিরোধী পরিসরে ‘পরিবর্তন’ লইয়া নানাবিধ সূক্ষ্মবিচার চলিতেছে বটে, তবে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করিয়া বামপন্থীদের একাংশ যেমন ভাবে কৃতার্থ বোধ করিতেছেন তাহা দেখিয়া কিঞ্চিৎ করুণা হয়, বিশেষত বিরোধী শিবিরের ঝুলিতে ভোটের সামগ্রিক অনুপাত যখন ত্রিশ শতাংশেও পৌঁছাইতে পারে নাই এবং ১৪৪টি ওয়ার্ডের মধ্যে তাহাদের মোট প্রাপ্তি যখন ১০! অন্য দিকে, এই ফলাফলকে বিজেপির পাতালপ্রবেশ এবং বামের পুনরুত্থানের সূচনাবিন্দু বলিয়া ধরিয়া লইলেও পরিণত বুদ্ধির পরিচয় দেওয়া হইবে না। ভবিষ্যতে কী ঘটিবে, তাহা ভবিষ্যৎই বলিতে পারে, এই ফল হইতে তাহার সম্পর্কে অনুমানের ফানুস উড়াইবার অপেক্ষা টিয়াপাখির নিকট ভাগ্যগণনা করানো শ্রেয়। আপাতত হাতে রহিল নিরঙ্কুশ বর্তমান: ৭২ শতাংশ ভোট পাইয়া তৃণমূল কংগ্রেস কলিকাতার ছোট (এবং নবান্ন-যুগে অদ্বিতীয়) লালবাড়িতে একচ্ছত্র রাজত্ব করিবে।
এই ৭২ শতাংশ ভোটই কি খাঁটি? কে সেই প্রশ্নের উত্তর দিবে? দুধ হইতে জলকে কে আলাদা করিবে? যাঁহারা ভোটে জয়ী, বুক ফুলাইয়া সাফল্যের গৌরব করিতে তাঁহাদের এক শতাংশও বাধে নাই, আবিরের রংও কিছুমাত্র ফিকা হয় নাই। তবে কিনা, তাঁহাদের মধ্যে ঈষৎ বিবেকবুদ্ধিসম্পন্ন কেহ কেহ হয়তো বা উল্লাস-যাপনের শেষে আপন গৃহে ফিরিবার কালে এই কথাটি ভাবিয়া মৃদু দীর্ঘশ্বাস ফেলিয়াছেন যে, দুধ সম্পূর্ণ খাঁটি হইলে তাহার স্বাদ না-জানি আরও কত উপাদেয় হইত। ছাপ্পা ভোট, বিপক্ষের ভোটদাতা ও এজেন্টদের হুমকি ইত্যাদির যে বিপুল অভিযোগ শহর জুড়িয়া উঠিয়াছে, তাহা সম্পূর্ণ মিথ্যা হইলে হয়তো ভোটের শতাংশ ৭২ হইতে কিছু কমিত, কিন্তু বিজয়ীর সম্মান তাহাতে বহুগুণ বাড়িত না কি? মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় সময় পাইলে ভাবিয়া দেখিতে পারেন। বস্তুত, রাজনৈতিক সাফল্যের শিখরে আরোহণ করিয়াও যে উদার গণতন্ত্রের ধ্বজাটিকে সসম্মানে বহন করা যায়, তাহা দেখাইয়া দিবার এক উৎকৃষ্ট সুযোগ আনিয়া দিয়াছিল এই পুরনির্বাচন, কিন্তু শাসকরা তাহার সদ্ব্যবহার করিতে পারেন নাই। হয়তো সদ্ব্যবহারের যথার্থ কোনও সদিচ্ছাও তাঁহাদের অন্তরে ছিল না।
ভোটের ফল ঘোষণার পরেও তেমন সদিচ্ছার সঙ্কেত মিলে নাই। দলনেতারা যথাবিহিত সুভাষিত উচ্চারণ করিয়াছেন বটে, কিন্তু শহরের নানা স্থানে ‘বিজয় উৎসব’-এর নামে দলীয় সমর্থকদের যথেচ্ছাচার শুধুমাত্র কোভিড বিধি এবং শব্দ-সীমা ভাঙিয়াই ক্ষান্ত হয় নাই, বিরোধীদের উপর চড়াও হইয়া ভাঙচুর এবং মারধরের তাণ্ডবেও পর্যবসিত হইয়াছে। দলনেতারা একাধিক ক্ষেত্রে এই সকল অভিযোগ কার্যত স্বীকার করিয়াও প্রকারান্তরে সাফাই গাহিয়াছেন— অনুগামীরা কোথাও ‘জয়ের আনন্দে’, কোথাও ‘উত্তেজনার বশে’ এমন সব ধুন্ধুমার করিয়া ফেলিয়াছে! অর্থাৎ— ছোট ছোট ছেলেদের ছোট ছোট দুষ্টুমি। আনন্দ এবং প্রতিহিংসা কেন এমন ভাবে এক স্রোতে লীন হইয়া যায়, নায়কনায়িকারা কখনও ভাবিয়া দেখিয়াছেন কি? নির্বাচনী অনাচারের অভিজ্ঞতা এই রাজ্যে নূতন নহে। সর্ব-হারা বামপন্থীরা এখন সুশান্ত পবিত্রতার প্রতিমূর্তি সাজিতেছেন, কিন্তু তাঁহাদের সুদীর্ঘ রাজত্বে নির্বাচনী প্রক্রিয়া কী ভাবে কলুষিত হইত, বিরোধীদের উপর কী ধরনের দমন-পীড়ন চলিত তাহা রাজ্যবাসী বিস্মৃত হন নাই। গত শতাব্দীতে কংগ্রেসি জমানার শেষের দিকের নির্বাচনী দুরাচারের কথাও ইতিহাসের পাতা উল্টাইলেই সহজে জানা যাইবে। কিন্তু বর্তমান শাসকদের সুযোগ ছিল সেই ইতিহাস বদলাইবার। তাহা হয় নাই। তাঁহারা জয়ী হইয়াছেন, বোধ করি সুখীও হইয়াছেন, কিন্তু সুখ আর সম্মান এক নহে। এক শত শতাংশ ভোট পাইলেও সেই সম্মান অধরা থাকিয়া যাইতে পারে।