প্রতীকী ছবি।
জাল টিকা-কাণ্ডের নায়ক দেবাঞ্জন দেব যাহাতে কঠোরতম শাস্তি পায়, সেই ব্যবস্থা করিতে নির্দেশ দিয়াছেন স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী। তাহার বিরুদ্ধে খুনের প্রচেষ্টার মামলাও দায়ের করিতে বলিয়াছেন। আশা করা যায়, প্রশাসন এই ঘটনার গুরুত্ব অনুধাবন করিবে; দ্রুত তদন্ত করিয়া কঠোর মামলা সাজাইবে, যাহাতে অভিযুক্তের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা হয়। এমন শাস্তি, যাহা ভবিষ্যতের সম্ভাব্য অপরাধীদের মনে ভয় সৃষ্টি করিবে— এমন অপরাধ করিতে কেহ সাহস পাইবে না। দেবাঞ্জন দেব, বা মুম্বইয়ের জাল টিকা-কাণ্ডে জড়িতদের অপরাধের তাৎপর্য ভয়াবহ। তাহার প্রত্যক্ষ ফল, টিকাগ্রহীতার জীবনহানির আশঙ্কা। কলিকাতায় যেমন কোভিড-এর টিকার পরিবর্তে দেওয়া হইয়াছে একটি বিশেষ অ্যান্টিবায়োটিকের ইঞ্জেকশন। সেই অ্যান্টিবায়োটিকে কোনও গ্রহীতার বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয় কি না, তাহা যাচাই করিয়া লইবার প্রশ্নই উঠে নাই। ফলে, এই নকল টিকায় কাহারও মৃত্যুও হইতে পারে। এই কারণেই অপরাধীর বিরুদ্ধে খুনের প্রচেষ্টার মামলা দায়ের করিবার কথা উঠিয়াছে। কিন্তু, ইহাই একমাত্র ক্ষতি নহে। নকল টিকা— এবং, তাহা লইয়া বিরোধীদের নিরন্তর রাজনৈতিক প্রচার— মানুষের মনে একটি সুতীব্র অবিশ্বাসের জন্ম দিতে পারে। যে কোনও টিকাকরণ কর্মসূচিতেই মানুষের সন্দেহ হইতে পারে যে, উহা ভুয়া কর্মসূচি। এই অবিশ্বাসের প্রভাব যদি টিকা গ্রহণের হারের উপর পড়ে, তাহা সুসংবাদ হইতে পারে না। বিশেষত, অতিমারির তৃতীয় প্রবাহ যখন দরজায় কড়া নাড়িতেছে।
খাস কলিকাতায়, পুলিশের নাকের ডগায়, এমন ভয়ঙ্কর একটি কাণ্ড কী ভাবে চলিতেছিল, স্বভাবতই সেই প্রশ্ন উঠিতেছে। এবং, তাহাতে যে ছবিটি ফুটিয়া উঠিতেছে, তাহাতে মূলত দুইটি রং। এক, এমন সন্দেহের বিলক্ষণ কারণ আছে যে, পুলিশ-প্রশাসনের একাংশ সজ্ঞানে এই জালিয়াতিতে সহযোগিতা করিয়াছে। যাঁহাদের হাতে টিকার ব্যবস্থাপনার ভার ন্যস্ত; শহরের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উপর নজরদারি করা, আইনের শাসন বজায় রাখিবার দায় যাঁহাদের— তাঁহারা কেহ ঘুণাক্ষরেও এত বড় কাণ্ডটি টের পান নাই, তাহা মানিতে হইলে প্রশাসনের উপর সমস্ত ভরসা হারাইতে হয়। অনেক বেশি বিশ্বাসযোগ্য ব্যাখ্যা হইল— যোগসাজশ ছিল, এবং তাহার জোরেই জালিয়াতটি এত দূর আগাইতে পারিয়াছিল। অপরাধ ধরা পড়িবার পর যে ভঙ্গিতে বলির পাঁঠার খোঁজ হইতেছে, তাহাতে সন্দেহ হয় যে, রাঘব বোয়ালদের আড়াল করিবার খেলা চলিতেছে। এই রাঘব বোয়ালগুলি যাহাতে তদন্তের জাল কাটিয়া পালাইতে না পারে, তাহা নিশ্চিত করিতে হইবে। এই লোকগুলিরও দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হওয়া জরুরি।
ঘটনার অন্য দিকটি হইল গা-ছাড়া মনোভাব। সংশ্লিষ্ট জালিয়াতটি বিভিন্ন ভাবে পুলিশে ও প্রশাসনিক মহলে বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করিয়াছিল— কখনও বিনামূল্যে মাস্ক-স্যানিটাইজ়ার বিলি করিয়া, কখনও অন্য কোনও ভাবে। সংবাদে প্রকাশ, ‘চেনা লোক’ হইবার সুবাদে জালিয়াতটির কার্যকলাপের দিকে পুলিশ যথেষ্ট গুরুত্ব সহকারে তাকায় নাই। সজ্ঞানে জালিয়াতিতে সাহায্য করিবার সঙ্গে এই অসাবধানতার বিলক্ষণ ফারাক আছে। ইহাও সত্য যে, পুলিশের উপর কাজের চাপ যতখানি, সেই তুলনায় লোকবল কম— ফলে, সব প্রশ্নকেই সমান গুরুত্ব দেওয়া পুলিশের পক্ষেও কার্যত অসম্ভব। কিন্তু, কোনও যুক্তিতেই এই গাফিলতির গুরুত্ব কমে না, তাহা ক্ষমার যোগ্য হইয়া উঠে না। দেবাঞ্জন দেবের কঠোরতম শাস্তি হওয়া অবশ্যই প্রয়োজন— কিন্তু, যাহাতের সজ্ঞান ও অ-জ্ঞান সহযোগিতায় সে এত বড় একটি কাণ্ড ঘটাইতে পারিল, তাহাদেরও শাস্তি হওয়া সমান জরুরি। নচেৎ, বিষচক্রটি ভাঙিবে না।