Manipur Violence

নৈতিক আস্থার প্রশ্ন

প্রধানমন্ত্রী কথা বললেও আশ্বস্ত হওয়ার কোনও কারণ থাকবে কি না, সেই প্রশ্নও অযৌক্তিক নয়। মণিপুর নিয়ে সুদীর্ঘ ৭৫ দিনের মৌন পালনের পরে শেষ অবধি মুখ তো তিনি এক বার খুলেছেন।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২৭ জুলাই ২০২৩ ০৮:২৬
Share:

সারা দেশের প্রায় দু’ডজন বিরোধী দল প্রধানমন্ত্রীর কাছে একটিই দাবি জানিয়েছে। পদত্যাগের দাবি নয়, এমনকি মার্জনা ভিক্ষার দাবিও নয়, মণিপুরের ভয়াবহ ঘটনা এবং পরিস্থিতি নিয়ে সংসদে দাঁড়িয়ে একটি বিবৃতি দেওয়ার দাবি। যে প্রধানমন্ত্রী এই সে-দিন আমেরিকার আইনসভায় ভারতীয় গণতন্ত্রের মহিমা কীর্তন করে এসেছেন, বিরোধীদের দাবিতে সাগ্রহে সাড়া দিয়ে তিনি এমন একটি গুরুতর বিষয়ে সংসদীয় আলোচনার আয়োজন করবেন এবং সেই আলোচনায় নেতৃত্ব দিতে এগিয়ে আসবেন— দুনিয়ার বৃহত্তম গণতন্ত্রে এটাই প্রত্যাশিত ছিল। কেবল প্রত্যাশিত নয়, স্বাভাবিক। কিন্তু নরেন্দ্র মোদীর ভারতে এখন স্বাভাবিকতার সংজ্ঞা স্বতন্ত্র এবং বিপরীত। সেখানে দীর্ঘ ন’বছরের মধ্যে দেশের প্রধানমন্ত্রী কার্যত এক বারও সত্যকারের সাংবাদিক সম্মেলন করেন না, তীব্র সঙ্কটকালীন পরিস্থিতিতেও কোনও মন্তব্য করেন না, কারও কোনও প্রশ্নের সদুত্তর দেন না, কেবল নিজের মর্জিমাফিক ‘মন কি বাত’ প্রচার করেন। এই ভারতে সরকারের প্রধান হিসাবে প্রশ্ন এবং সমালোচনার জবাব দেওয়ার দায়িত্বটিই স্বীকৃত নয়। এখানে প্রধানমন্ত্রীকে কথা বলানোর কৌশল হিসাবে বিরোধী দলগুলিকে সংসদে অনাস্থা প্রস্তাব আনার উদ্যোগ করতে হয়!

Advertisement

প্রধানমন্ত্রী কথা বললেও আশ্বস্ত হওয়ার কোনও কারণ থাকবে কি না, সেই প্রশ্নও অযৌক্তিক নয়। মণিপুর নিয়ে সুদীর্ঘ ৭৫ দিনের মৌন পালনের পরে শেষ অবধি মুখ তো তিনি এক বার খুলেছেন। কিন্তু প্রথমত, সে বিষয়ে তাঁর অমূল্য সময়ের ভান্ডার থেকে দু’মিনিটের বেশি খরচ করেননি; দ্বিতীয়ত, ‘দুঃখে এবং রাগে’ মন ভরে রয়েছে, ইত্যাকার সদুক্তি বিতরণেই সীমিত থেকেছেন। কিন্তু, এহ বাহ্য। এই উপলক্ষে তিনি মণিপুরের সঙ্গে সঙ্গে বেছে বেছে রাজস্থান বা ছত্তীসগঢ়ের মতো (কংগ্রেস শাসিত) রাজ্যে নারী নির্যাতনের ঘটনাকেও জড়িয়ে নিয়েছেন। ইংরেজি ভাষায় যা অধুনা ‘হোয়রঅ্যাবাউটারি’ নামে নিন্দিত, নিজের অপরাধ বা দোষত্রুটির দায় এড়াতে অন্যের অপরাধ বা দোষত্রুটির দিকে আঙুল তোলার সেই অভ্যাসটি কোনও প্রসঙ্গেই প্রধানমন্ত্রীর মুখে মানায় না। বর্তমান ভারতে সেই সব আত্মমর্যাদার কথাও নাহয় ছেড়ে দেওয়া গেল, কিন্তু মণিপুরের বিভীষিকার প্রসঙ্গেও তিনি— ভারতের প্রধানমন্ত্রী— অম্লানবদনে ‘তোমরাও করেছ, তার বেলা?’ ধুয়ো তুলে কথা ঘোরাতে তৎপর হবেন! নিজের আসনের গুরুত্ব বা সম্ভ্রম সম্পর্কে সামান্যতম বোধের পরিচয়ও দেবেন না?

এই পরিপ্রেক্ষিতেই বিরোধীদের উদ্যোগটি বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে, প্রধানমন্ত্রীকেই সংসদে কথা বলতে হবে, এমন ‘জেদ’ তাঁরা কেন করছেন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর বিবৃতিকেই তাঁরা কেন যথেষ্ট মনে করছেন না? এই প্রশ্নের সহজ উত্তর: এটা নৈতিকতার প্রশ্ন, নৈতিক দায়িত্ব স্বীকার করবার প্রশ্ন। প্রধানমন্ত্রীর দায়িত্ব কেবল বিজেপি শাসিত মণিপুরের ক্ষেত্রে নয়, বিজেপি শাসিত ভারতের ক্ষেত্রে দুঃশাসনের জন্য জবাবদিহি করা এবং তার প্রতিকারের বিশ্বাসযোগ্য পদক্ষেপ করা। এর কোনওটিই তিনি বা তাঁর শাসনযন্ত্রীরা করেননি, করছেন না, করবেন বলে দেশবাসীর মনে কোনও আস্থাও তৈরি করছেন না। অনাস্থা প্রস্তাবের মৌলিক গুরুত্ব এখানেই। এই প্রস্তাব সরকারের পতন ঘটাতে পারবে না, কিন্তু এর মধ্যে নিহিত আছে প্রধানমন্ত্রী এবং তাঁর সরকারের প্রতি, বৃহত্তর অর্থে শাসক দলের প্রতি, নৈতিক অনাস্থার ঘোষণা। সেই ঘোষণা নবগঠিত ‘ইন্ডিয়া’র। প্রধানমন্ত্রী এবং তাঁর পারিষদবর্গ এই ঐক্যমঞ্চকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করার যতই চেষ্টা করবেন, তিনি নিজে যতই ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বা জঙ্গি গোষ্ঠীর প্রসঙ্গ টেনে এনে ‘ইন্ডিয়া’ নামক বিরোধী জোটের নাম কলঙ্কিত করবেন, ততই এই সত্য আরও স্পষ্ট হয়ে উঠবে যে, বিরোধীদের সমন্বয় এবং নৈতিক প্রতিস্পর্ধার নতুন উদ্যম দেখে শাসকরা উদ্বিগ্ন। এই উদ্বেগ গণতন্ত্রের পক্ষে সুলক্ষণ।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement