দক্ষিণপন্থী শাসকবলয়ের বিরুদ্ধে মুখ খুললে তার পরিণতি ভাল হয় না— এ কথা আজকের ভারতে সত্য থেকে আরও সত্য হয়ে উঠছে। ইদানীং কর্নাটকে হিন্দুত্ববাদীদের দাপট ক্রমবর্ধমান, শিক্ষাঙ্গনে হিজাব নিয়ে আপত্তির পরে মন্দির-চত্বরে মুসলমানদের ব্যবসা রদ করার দাবিও তুলেছে দক্ষিণপন্থী গোষ্ঠী, সঙ্গে হালাল মাংস বিক্রির বিরোধিতাও শোনা গিয়েছে। আর, এর প্রেক্ষিতেই শিল্পপতি কিরণ মজুমদার শ যখন সাম্প্রদায়িকতার বিপদ নিয়ে টুইট করেছেন, তখন তাঁকে আক্রমণে ঘিরে ধরেছে গেরুয়া শিবির। কিরণের মন্তব্য যথার্থ— সাম্প্রদায়িক ঘৃণার বশে সমাজে বিভাজন তৈরি হলে তা অর্থনৈতিক বিকাশের ক্ষতি করবে, আন্তর্জাতিক ভাবে বাণিজ্যক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়বে দেশ। এই কথার পরে শাসক দলের নেতারা যে ভাবে তাঁকে কটাক্ষ করেছেন, এবং কিরণের উপর্যুপরি আবেদন সত্ত্বেও কর্নাটকের মুখ্যমন্ত্রীর তরফে কোনও স্পষ্ট আশ্বাস মেলেনি, তাতে তাঁর অভিযোগের সারবত্তাই প্রমাণিত হয়। যে বহুত্ববাদী সংস্কৃতিতে আধুনিক ভারতের বিকাশ, তা ক্রমশ হিন্দুত্ববাদী সংস্কৃতির একশিলার ছাঁচে ঢুকে পড়ছে। নষ্ট হচ্ছে তার এই দেশের আত্মা, চরিত্র।
বিপদটি ক্ষুদ্রস্বার্থের রাজনীতিসঞ্জাত। সাম্প্রতিক ঘটনাবলি বলবে, বিধানসভা নির্বাচন এগিয়ে আসার সঙ্গে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির উচ্চগ্রামের একটি সরাসরি সম্পর্ক আছে। সদ্যসমাপ্ত উত্তরপ্রদেশ ভোটের প্রচারপর্ব শুরুর ঠিক আগেই কাশী বিশ্বনাথ করিডরের উদ্বোধন করেছিলেন প্রধানমন্ত্রী, অযোধ্যাকে তাঁদের ‘পরিচিতি প্রশ্ন’ বলে চিহ্নিত করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথ। এর সঙ্গে, আশি বনাম কুড়ি শতাংশের হিসাব শোনানো অথবা দুর্নীতি ও ‘বিশেষ সম্প্রদায়’-কে এক সঙ্গে জড়িয়ে ফেলার মতো মন্তব্যগুলিও তাঁদের কথায় বার বার উঠে এসেছে। কর্নাটকের মুখ্যমন্ত্রী বাসবরাজ বোম্মাইও যে সেই পথেরই পথিক তা বুঝতে অসুবিধা হয় না— চার রাজ্যে বিজেপির জয়ের পরে দায়িত্বপ্রাপ্ত তিন রাজ্য-নেতাকে সংবর্ধনা জানান তিনি, এবং ‘মানুষ হিন্দুত্ববাদী রাজনীতিকে বিশেষ ভাবে গ্রহণ করেছে’ বলে উল্লেখও করেন। অর্থাৎ, যে সংগঠিত রাজনীতিতে ভরসা রেখে কর্নাটক পুনর্দখলের কথা প্রকাশ্যে বলছেন বোম্মাই, এই নিয়মিত ঘৃণার চাষ বাস্তব জমিতে তারই প্রতিফলন।
সামাজিক ভাবে সমস্যাটি গভীরতর, কেননা হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি শুধুমাত্র নিজেকে প্রবল ভাবে আরোপ করেই শেষ হয় না, যাবতীয় বিরোধিতাকে কদর্য ভাবে আক্রমণ করাও তার ধরন। কিরণের মতো উদারমনস্ক উদ্যোগপতিরা তাই বার বার এই রাজনীতির রোষানলে পড়েন। মনে থাকবে, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের সামনে দেশে ভীতির পরিবেশ বিষয়ে মন্তব্য করে কী ভাবে আইটি সেলের ‘ট্রোল’ বা কটাক্ষ-আক্রমণের মুখে পড়েছিলেন প্রয়াত রাহুল বজাজ। ‘ট্রোল’ কদাপি উদ্দেশ্যহীন নয়— বিরোধী মতামতের উপর হামলা চালিয়ে তাকে চুপ করিয়ে দিতে পারলে তবেই রাজনীতির সর্বাধিপত্য প্রতিষ্ঠার পথটি নিরঙ্কুশ হয়। গত আট বছরে এ ভাবেই বিরোধী মতাবলম্বী রাজনীতিবিদ, আমলা, উদ্যোগপতিদের তীব্র কটাক্ষ-আক্রমণ করে সমাজের প্রতিবাদী স্বরগুলিকে স্তব্ধ করতে চেয়েছে শাসকের ‘ট্রোল’বাহিনী। গণতন্ত্রের পক্ষে এর চেয়ে বড় বিপদ কিছু হতে পারে না।