New Parliament Building

‘দেশদ্রোহী’

‘বেটি বচাও বেটি পঢ়াও’ প্রকল্পের দূত হিসাবে নিযুক্ত হয়েছিলেন পদকজয়ী কুস্তিগির। সেই ভরসাতেই তাঁরা ভেবেছিলেন, প্রধানমন্ত্রী তাঁদের কথা শুনবেন।

Advertisement
শেষ আপডেট: ৩০ মে ২০২৩ ০৫:৩৯
Share:

সাক্ষী মালিক, বজরং পুনিয়া, বিনেশ ফোগটদের টেনে-হিঁচড়ে তুলে নিয়ে যায় কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের অধীন দিল্লি পুলিশ। ফাইল চিত্র।

এক-একটি দিন সময়ের কপালে ইতিহাসের অনপনেয় স্বাক্ষর হিসাবে থেকে যায়, নতুন সংসদ ভবনের উদ্বোধন করে বললেন প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। সত্যিই, স্বাধীন ভারতের ইতিহাসে ২৮ মে ২০২৩ তারিখটি অনপনেয় হল। সাক্ষী মালিক, বজরং পুনিয়া, বিনেশ ফোগটদের টেনে-হিঁচড়ে তুলে নিয়ে যাওয়ার পর বহুবিধ ধারায় তাঁদের বিরুদ্ধে এফআইআর করল কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের অধীন দিল্লি পুলিশ। অভিযোগের সেই তালিকায় ‘অ্যান্টি-ন্যাশনাল’ কথাটি নেই, কিন্তু আন্তর্জাতিক পদকজয়ী এই কুস্তিগিরদের বিরুদ্ধে প্রকৃত অভিযোগ হতে পারত সেটাই— কেননা নরেন্দ্র মোদীর সরকার যে ‘নেশন’ নির্মাণ করছে, এবং রাষ্ট্রের সত্তায় যাকে সম্পূর্ণ আরোপ করতে সক্ষম হয়েছে, সাক্ষীদের আচরণের মধ্যে সেই ‘নেশন’-এর প্রতি বিরুদ্ধতা প্রকট। এই নেশনে রাষ্ট্রনায়কদের প্রতি অভিযোগের আঙুল তোলা যায় না— বিশেষত, তাঁরা যখন ভরসাফুর্তি উৎসবে ব্যস্ত, তখন তো নয়ই। অতীতে, এই সফল কুস্তিগিররা যখন ক্ষমতাসীনদের প্রতি অভিযোগ তোলেননি, তখন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী তাঁদের থেকে হাত পেতে নিয়েছিলেন তাঁদের স্বাক্ষর করা জার্সি। ‘বেটি বচাও বেটি পঢ়াও’ প্রকল্পের দূত হিসাবে নিযুক্ত হয়েছিলেন পদকজয়ী কুস্তিগির। সম্ভবত সেই ভরসাতেই তাঁরা ভেবেছিলেন, প্রধানমন্ত্রী তাঁদের কথা শুনবেন। প্রধানমন্ত্রী ‘গণতন্ত্রের নতুন মন্দির’-এর উদ্বোধনে সাষ্টাঙ্গ প্রণাম করলেও নাগরিকদের কথা শোনার গণতন্ত্রে তাঁর রুচি নেই— জেলে বন্দি থাকা নাগরিক সমাজের বহু প্রতিনিধি সেই অরুচির সাক্ষ্য দেবেন। এই ‘নেশন’ প্রতিবাদ সহ্য করতে পারে না, প্রধানমন্ত্রীর আনন্দের মুহূর্তে তো নয়ই।

Advertisement

কিন্তু, হয়তো শুধু এই কারণেই তাঁরা এই ‘নতুন’ রাষ্ট্রতন্ত্রের বিরোধী নন। দেশের পদকজয়ী মহিলা কুস্তিগিররা এক মাসেরও বেশি প্রতিবাদ করে চলেছেন যৌন নিগ্রহের বিরুদ্ধে— তাঁদের অভিযোগ কুস্তি ফেডারেশনের প্রধান, বিজেপি সাংসদ ব্রিজভূষণ শরণ সিংহের প্রতি। নরেন্দ্র মোদী শাসিত ভারতে শাসক দলের নেতার বিরুদ্ধে কোনও অভিযোগই গ্রাহ্য হয় না— সে অভিযোগ যৌন নিগ্রহের হোক, সংখ্যালঘুর উদ্দেশে ঘৃণাভাষণের হোক, অথবা বিক্ষোভরত নাগরিককে গাড়ির চাকায় পিষে মারারই হোক। অতএব, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী যে খেলোয়াড়দের একদা দেশের গর্ব বলেছিলেন— নিন্দকের মতে, তাঁদের অর্জিত কৃতিত্বের ছটা নিজের দিকে টেনে আনতে চেয়েছিলেন— তাঁরাও যদি কোনও বিজেপি সাংসদের বিরুদ্ধে যৌন হেনস্থার অভিযোগ তোলেন, সেই আচরণ নতুন দেশের বিরুদ্ধে বিদ্রোহই বটে। তাকে দমন করাই স্বাভাবিক। আর একটি প্রশ্নও থেকে যায়। যে রাষ্ট্র মনেপ্রাণে মনুবাদী হতে চাইছে, সেখানে যৌন হেনস্থার অভিযোগ তোলার সাহস কি মেয়েদের হওয়ার কথা? এমনকি নারী জনপ্রতিনিধিও এই তন্ত্রে ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের পৌরুষের শিকার। মহারাষ্ট্রে বিজেপির রাজ্য সভাপতি এনসিপি নেত্রী সুপ্রিয়া সুলেকে বলেছিলেন, বাড়িতে গিয়ে রান্নাবান্না করুন। সেই মন্তব্য উচ্চ নেতৃত্বের দ্বারা তিরস্কৃত হয়নি। বিজেপি নেতা কৈলাস বিজয়বর্গীয় রাস্তায় মহিলাদের পাঁচ-সাতটি থাপ্পড় মারার সদিচ্ছা প্রকাশ করেছিলেন। এই জমানায় সাক্ষী-বিনেশরা রাষ্ট্রের সেই পুরুষতান্ত্রিক শাসনের দিকে আঙুল তুলেছিলেন। ২৮ মে বুঝিয়ে দিল, এ দেশে সেই ঔদ্ধত্য আর বরদাস্ত নয়।

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement