Galwan

ধাঁধার বর্ষপূর্তি

সত্য ঘটনা জানিতে চাওয়া ভারতীয় নাগরিকের আবদার নহে, তাহা নাগরিকের অধিকার।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২১ জুন ২০২১ ০৫:৪৫
Share:

গালোয়ান সংঘর্ষের এক বৎসর পূর্ণ হইবার প্রহরে পুরাতন প্রশ্ন এবং সংশয়গুলি আরও এক বার পাক খাইয়া উঠিয়া আসিল। প্রশ্ন/সংশয় না বলিয়া ইহাদের ধাঁধাও বলা যাইতে পারে। ষাটের দশকের ভারত-চিন যুদ্ধের পর এই প্রথম দুই দেশ এত বড় সংঘর্ষে লিপ্ত হইল, কিন্তু এমন মহামুহূর্তেও ভারতীয় নাগরিক সমাজ জানিতে পারিল না— যাহা হইল তাহা কেন হইল, কী হইল, কোথায়ই বা হইল। ভারত যদি শত্রুর পদক্ষেপণে আক্রান্ত হইল, তাহা হইলে কোন দিক হইতে আক্রমণ ঘটিল, না কি ভারতের কোনও পদক্ষেপণেই শত্রুর আক্রমণ ধাবিয়া আসিল। ভারত যদি যুদ্ধে সফল হইল, তবে কিসের ভিত্তিতে সেই সাফল্য আসিল। চিনা-অধিকৃত ভূমি কি ফিরিয়া পাওয়া গেল, না কি চিনারা সেই অধিকৃত ভূমিতেই অধিষ্ঠিত রহিল। যদি তাহাই রহিয়া গিয়া থাকে, তবে ভারতের সাফল্য আসিল কোন পথে। তাহারও আগে প্রশ্ন, ভারতের ভূমি যদি সরকারি মতে অধিকৃত হয়ই নাই, তবে সংঘর্ষ হইলই বা কেন, সংঘর্ষের বিরতিই বা কী ভাবে ঘটিল। চিন যদি ভারতের ভূমি অধিকার করিয়া থাকে, তবে কি পুরাতন সীমান্ত হইতে ভারত পশ্চাদপসরণ করিয়াছিল। ইত্যাকার ধাঁধালো আবর্তে পাক খাইতে খাইতে ধারালো জাতীয়তাবাদে উদ্বুদ্ধ হইয়া শক্তিশালী প্রতিবেশীর বিরুদ্ধে রাষ্ট্রকে যুদ্ধে সমর্থন করা দুরূহ ব্যাপার, কিন্তু ভারতীয় নাগরিক সমাজের একাংশ তাহাতে দমে নাই। প্রথামাফিক যুদ্ধকালীন জাতীয়তাবাদী আবেগে ভাসিতে ভাসিতে যাবতীয় প্রশ্ন দূরে নিক্ষেপ করিয়াছে। মনে করিয়াছে বিপদের দিনে বিব্রতকর প্রশ্ন করিয়া সরকারকে উত্তরদানের ঝঞ্ঝাটে ফেলা গণতন্ত্রসিদ্ধ নহে। ফলত, এক বৎসর কাটিল, কিন্তু গোড়ার ধাঁধাগুলি একই রকম অমীমাংসিত রহিয়া গিয়াছে।

Advertisement

সত্য ঘটনা জানিতে চাওয়া ভারতীয় নাগরিকের আবদার নহে, তাহা নাগরিকের অধিকার। অথচ অধিকাংশ বিরোধী নেতাও সরকারকে বিব্রত করিতে নারাজ, তাই এই বিষয়ে এক বৎসরে তাঁহারা উচ্চবাচ্য করেন নাই। ব্যতিক্রম হাতে-গোনা। রাহুল গাঁধী একাধিক বার তথ্যপ্রমাণ দাবি করিয়াছেন। এবং গালোয়ানের এক বৎসর পূর্ণ হইবার সময় কংগ্রেস প্রেসিডেন্ট সনিয়া গাঁধী নিহত জওয়ানদের প্রতি শ্রদ্ধা জানাইয়া বলিয়াছেন, গত বৎসর ১৫ জুনের সংঘর্ষ সম্পর্কে দেশবাসী এখনও অন্ধকারে, এপ্রিলের আগে যে প্রকৃত নিয়ন্ত্রণ রেখা (এলএসি) ছিল তাহাতে প্রত্যাবর্তনের বিষয়ে ভারত কত দূর অগ্রসর হইল— তাহার কোনও তথ্য মিলে নাই। ইহা, বাস্তবিক, এক আশ্চর্য প্রশাসনিক সিদ্ধান্ত। এত বড় কূটনৈতিক ও রাজনৈতিক ঘটনা বিষয়ে নাগরিককে এই ভাবে অন্ধকারে রাখিবার অধিকার কোনও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের আছে কি? জনগণের ভোটে নির্বাচিত সরকার জনগণের অর্থে যুদ্ধ চালনা করিবার সময় তাহার ভোটদাতাদের নিকট স্বচ্ছ তথ্যদানে বিরত থাকিতে পারে কি? সীমান্তে কী হইতেছে তাহা সাধারণ সময়ে জনসমক্ষে না আসিতে পারে, কিন্তু যখন বিশালাকার প্রতিবেশী দেশের সহিত যুদ্ধ-পরিস্থিতি তৈরি হয়, তখন— এবং এক বছর অতিক্রান্ত হইবার পরেও— সেই গোপনীয়তার কোনও যুক্তি থাকিতে পারে না। ভাবিতে ইচ্ছা করে, তবে কি এমন কিছু ঘটিয়াছে যাহাতে সরকারের দৌর্বল্য প্রমাণিত হইতে পারে, সেই কারণে এত চাপাচুপির বাড়াবাড়ি? প্রসঙ্গত, যেটুকু তথ্য সরকারের তরফে প্রকাশ করা হইয়াছিল, তাহাতেও বহু অসঙ্গতি ছিল, পরস্পর-বিরোধিতা ছিল। অনুমান সম্ভব, সীমান্তে যাহা ঘটিতেছিল, তাহা পরিষ্কার ভাবে প্রকাশ করা নরেন্দ্র মোদী সরকারের পক্ষে সমস্যাজনক। অথচ, রাষ্ট্রের নিরাপত্তা কিন্তু এমনই একটি গুরুতর বিষয় যে সরকারের পক্ষে সমস্যাজনক বলিয়া সত্যকে যদি চাপিয়া রাখা হয়, তবে শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রের ভিত্তিটিই বিপন্ন হইতে পারে।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement