Nobel Prize in Economics

দুঃসময়ের মন্ত্র

অতিমারির ফলে বৈশ্বিক অর্থব্যবস্থার যে ক্ষতি হয়েছিল, সেই ক্ষতের নিরাময় হওয়ার বদলে রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ তৈরি করেছে গভীরতর বিপদ।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৫ অক্টোবর ২০২২ ০৬:২৩
Share:

নোবেল জয়ী আমেরিকার তিন অর্থনীতিবিদ।

নোবেল কমিটি যখন ঘোষণা করল যে, এ বছর অর্থশাস্ত্রের পুরস্কার পাচ্ছেন বেন বার্নানকে, ডগলাস ডায়মন্ড ও ফিলিপ ডিবভিগ, তখন আর একটি অনুচ্চারিত কিন্তু অতি স্পষ্ট বার্তাও ছিল— পুরস্কারটি আসলে দুঃসময়কে স্বীকার করে নিচ্ছে। আমেরিকার সাব-প্রাইম সঙ্কট থেকে তৈরি হওয়া মন্দার ধাক্কা সম্পূর্ণ মিলিয়ে যাওয়ার আগেই দুনিয়া দাঁড়িয়ে আছে আরও একটি মন্দার খাদের কিনারায়। অতিমারির ফলে বৈশ্বিক অর্থব্যবস্থার যে ক্ষতি হয়েছিল, সেই ক্ষতের নিরাময় হওয়ার বদলে রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধ তৈরি করেছে গভীরতর বিপদ। বিশ্ব ব্যাঙ্ক বা আন্তর্জাতিক অর্থ ভান্ডার, সব প্রতিষ্ঠানই আশঙ্কা জানাচ্ছে যে, অদূর ভবিষ্যতেই আরও একটি মন্দা অপেক্ষা করে আছে। মন্দার সঙ্গে ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থার সম্পর্ক কী? প্রচলিত ধারণা ছিল, মন্দার কারণে ব্যাঙ্ক ফেল করতে পারে। ১৯২৯-৩৩’এর মহামন্দায় একের পর এক ব্যাঙ্ক ফেল করাকে সেই সম্পর্কের সাক্ষী মানা হত। এ বছর অর্থশাস্ত্রের অন্যতম নোবেলজয়ী বেন বার্নানকে মহামন্দার সময়কার বিপুল তথ্য ও পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করেই দেখিয়েছিলেন যে, ব্যাঙ্ক ফেল করা মন্দার ফলাফল নয়, বরং অন্যতম কারণ।

Advertisement

১৯৮০-র দশকের গোড়ার দিকের সেই গবেষণাটিকেই নোবেল কমিটি স্বীকৃতি জানিয়েছে। ঐতিহাসিক তথ্য ঘেঁটে বার্নানকে যে আখ্যানটি পেশ করেছেন, তার যুক্তি জটিল নয়। ব্যাঙ্ক ফেল করে বিশ্বাসের অভাবে— মানুষ যখন বিশ্বাস করতে পারে না যে, ব্যাঙ্ক তাদের জমানো টাকা ফেরত দিতে পারবে, তখন সবাই নিজেদের টাকা তুলে নিতে ব্যাঙ্কে ছোটে। সব গ্রাহক একই সঙ্গে টাকা ফেরত চাইলে তা দেওয়ার উপায় নেই ব্যাঙ্কের, কারণ সেই টাকাই ঋণ হিসাবে দেওয়া রয়েছে। অতএব, সবাই এক সঙ্গে টাকা তুলে নিতে চাইলে শেষ পর্যন্ত ঝাঁপ ফেলা ছাড়া ব্যাঙ্কের উপায় নেই। এবং, একটি ব্যাঙ্ক ফেল করলে অন্য ব্যাঙ্কের স্বাস্থ্য নিয়েও প্রশ্ন তৈরি হয় গ্রাহকের মনে, ফলে সেখানেও কালক্রমে একই ঘটনা ঘটে। বার্নানকে দেখিয়েছেন যে, মহামন্দার সময় এই আশঙ্কাতেই ব্যাঙ্কগুলি দীর্ঘমেয়াদি ঋণ দেওয়ার বদলে আমানতের টাকা লগ্নি করেছিল এমন সম্পদে, যা থেকে সহজেই টাকা তুলে নেওয়া যায়। ফলে, উৎপাদনশীল বিনিয়োগের পরিমাণ হ্রাস পেয়েছিল। এবং, তার ফলেই ধাক্কা লেগেছিল জিডিপি-র অঙ্কে, মন্দা গভীরতর হয়েছিল। এই ঐতিহাসিক পর্যবেক্ষণটির প্রতিফলন ঘটেছিল ২০০৮ সালের মন্দায়— বার্নানকে তখন আমেরিকার ফেডারাল রিজ়ার্ভ-এর কর্ণধার— গভীর বিপাকে পড়া ব্যাঙ্কগুলিকে ‘বেল আউট’ করেছিল সরকার। তৈরি হয়েছিল একটি নতুন বাক্যবন্ধ— ‘টু বিগ টু ফেল’।

ডায়মন্ড ও ডিবভিগের গবেষণাটিও প্রায় চার দশকের পুরনো। তাঁদের গবেষণার মূল কথাটিও সহজবোধ্য, গাণিতিক জটিলতাহীন। আমানতকারীরা চান যে, ব্যাঙ্ক থেকে তাঁরা যেন ইচ্ছেমতো তাঁদের গচ্ছিত টাকা তুলে নিতে পারেন। অন্য দিকে, ঋণগ্রাহকরা এই নিশ্চয়তা চান যে, নির্দিষ্ট মেয়াদের আগে তাঁদের ঋণের টাকা ফেরত দিতে হবে না। অর্থাৎ, চরিত্রগত ভাবে স্বল্পমেয়াদি আমানত এবং দীর্ঘমেয়াদি ঋণ, এই দুইয়ের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করাই ব্যাঙ্কের কাজ। কাজটি গুরুত্বপূর্ণ, কারণ মধ্যস্থতাকারী প্রতিষ্ঠান হিসাবে ব্যাঙ্ক না থাকলে টাকা জমানো বা লগ্নি করা, এবং ঋণ গ্রহণ, দুটো কাজই অতি কষ্টসাধ্য ও ব্যয়বহুল হত। ডায়মন্ড ও ডিবভিগ ব্যাঙ্কিং ব্যবস্থায় মানুষের আস্থা বজায় রাখার জন্য সরকারি গ্যারান্টির পক্ষেও জোরদার সওয়াল করেছিলেন। এই তিন অর্থশাস্ত্রীর কাজকে স্বীকৃতি দেওয়ার মাধ্যমে নোবেল কমিটি একই সঙ্গে ব্যাঙ্কের গুরুত্ব, এবং আর্থিক সঙ্কটের মুহূর্তে সরকারের ভূমিকার কথাই স্মরণ করিয়ে দিল।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement