—প্রতীকী চিত্র।
এই-যে নববর্ষ আজ জগতের মধ্যে এসে দাঁড়িয়েছে, এ কি আমাদের হৃদয়ের মধ্যে প্রবেশ করতে পেরেছে? আমাদের জীবনে কি আজ নববর্ষ আরম্ভ হল?— ১৩১৮ বঙ্গাব্দের প্রথম প্রভাতে শান্তিনিকেতনে ভাষণের শুরুতে এই প্রশ্ন করেছিলেন ‘আশ্রমবাসী’ রবীন্দ্রনাথ। আজ, একশো তেরো বছর পরে, অধিকাংশ বঙ্গভাষীর কানে তাঁর কথাগুলি বোধ করি, কেবল অপরিচিত নয়, সম্পূর্ণ অবান্তর শোনাবে। নাগরিক বাঙালির জীবনে, বিশেষত পশ্চিমবঙ্গ নামক এই ভূখণ্ডে, নববর্ষ আজ নিতান্তই এক বিনোদনের লগ্ন: ‘এসো হে বৈশাখ’ সহযোগে প্রভাতফেরি এবং/অথবা সান্ধ্য আসর, ইতস্তত নানা আকারের অলঙ্কৃত ঘট ও সুসজ্জিত হাতপাখা, বাংলা অথবা রোমান ‘শুভ নববর্ষ’ লেখা অভিবাদনের পাশেই ‘অথেনটিক বেঙ্গলি কুইজ়িন’-এর আমন্ত্রণ, ইত্যাদি। সারা বছর ধরে এমন আরও বিস্তর লগ্ন আসে এবং চলে যায়, পিছনে রেখে যায় প্রভূত কলরবের প্রতিধ্বনি, যতক্ষণ না পরবর্তী বিনোদনের কোলাহল এসে তাকে গ্রাস করে। নববর্ষ ‘আমাদের হৃদয়ের মধ্যে প্রবেশ’ করার কথাই ওঠে না। সে কারণেই, এক সম্পূর্ণ বিপরীত ও স্বতন্ত্র উদ্যাপনের কথা জানায় বলেই, এই সময়ের শব্দতলায় বিশেষ ভাবে স্মরণ করা দরকার বাঙালির কবির সেই ভাষণের পরবর্তী অনুচ্ছেদটি, যেখানে তিনি বলছেন: “এই-যে বৈশাখের প্রথম প্রত্যুষটি আজ আকাশপ্রাঙ্গণে এসে দাঁড়ালো, কোথাও দরজাটি খোলবারও কোনো শব্দ পাওয়া গেল না, আকাশ-ভরা অন্ধকার একেবারে নিঃশব্দে অপসারিত হয়ে গেল, কুঁড়ি যেমন করে ফোটে আলোক তেমনি করে বিকশিত হয়ে উঠল— তার জন্যে কোথাও কিছুমাত্র বেদনা বাজল না। নববৎসরের উষালোক কি এমন স্বভাবত নিঃশব্দে আমাদের অন্তরে প্রকাশিত হয়?”
যা আছে, যা হয়ে আসছে, সেই পুরনোর মধ্য থেকেই স্বভাবত নিঃশব্দে নতুনের উন্মেষ ঘটে চলে— এই ধারণাটি রবীন্দ্রনাথের কবিতায়, গানে, নাটকে, প্রবন্ধে, ভাষণে অজস্র ভাবে প্রকাশিত হয়েছে। বস্তুত, এ তাঁর জীবনদর্শনের এক মৌলিক ধারণা, যে দর্শনের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়ে আছে প্রকৃতি সম্পর্কে তাঁর গভীর বোধ। প্রকৃতির ভিতরে নিরন্তর নিজেকে নতুন করে তোলার যে সাধনা জারি থাকে, সামাজিক মানুষের জীবনে তার অনুশীলন জরুরি, এই বোধের প্রেরণাতেই তিনি জীবনের শেষ অধ্যায় অবধি ঘোষণা করে গিয়েছেন: পুরাতনকে অস্বীকার করে নয়, তাকে একই সঙ্গে স্বীকৃতি দিয়ে এবং মন্থন করেই নতুন চিন্তা, নতুন ধারণা ও নতুন জীবনের সন্ধান করতে হবে, নান্যপন্থা বিদ্যতে অয়নায়। সেই মন্থন অবশ্যই নির্মোহ, যুক্তিনিষ্ঠ, অগ্রমুখী বিশ্লেষণের এক প্রক্রিয়া, তার প্রথম এবং প্রধান দাবি: চিন্তা ও চেতনার কঠোর পরিশ্রম। নববর্ষ সেই পরিশ্রমের উত্তরাধিকার হয়ে উঠতে পারলে তবেই তা সাংস্কৃতিক জীবনের যথার্থ উদ্যাপনের লগ্ন হতে পারে।
পরিতাপের কথা এই যে, পরিশ্রম নয়, আলস্যই এখন পশ্চিমবঙ্গের নাগরিক মনের ও মগজের অভ্যাসে পরিণত। জীবনের বিভিন্ন পরিসরে যে বিপুল দৈন্য এবং বিপুলতর ক্লান্তি উত্তরোত্তর সমাজ ও সংস্কৃতিকে গ্রাস করে ফেলছে, তা এই আলস্যের পরিণাম, আবার তার প্রতিবিম্বও। এই বাস্তবেরই সর্বময় ছাপ পড়ছে বাঙালির উৎসবে। তার উৎসবগুলি আজ আর সামাজিক মানুষের সমবেত উদ্যম ও উদ্যোগের মধ্য দিয়ে স্বাভাবিক ভাবে গড়ে ওঠার কোনও নিদর্শন নয়, তা কেবল ক্যালেন্ডার অনুসারে— এবং অধুনা সেই ক্যালেন্ডারকে প্রবল জোরে টেনে টেনে সম্প্রসারিত করে— প্রচণ্ড কলরব ও সাজসজ্জার উপলক্ষমাত্র। বাঙালির নববর্ষের উদ্যাপনেও তার ছাপ পড়বে, সেই উদ্যাপন কেবলমাত্র এক দিনের উল্লাসের— এবং আত্মগরিমার শূন্যকুম্ভ-নিনাদের— বুদ্বুদে পরিণত হবে, এর মধ্যে সম্ভবত বিস্ময়ের কিছু নেই। সামাজিক চেতনা ও চিন্তার অনুশীলনে যদি পরিবর্তন না ঘটে, তবে বুদ্বুদ তার নিজস্ব ধর্ম অনুসারেই অচিরে বিলীন হবে, দোসরা বৈশাখের সূর্য ওঠার আগেই বাঙালির নববর্ষ তার বিবর্ণ স্মৃতির ঝাঁপিতে বন্দি হয়ে পরবর্তী বঙ্গাব্দের প্রতীক্ষায় নিদ্রিত হবে। প্রশ্ন হল, সেই পরিবর্তন কী ভাবে সম্ভব? এই প্রশ্নের সদুত্তর যদি খুঁজতে হয়, তবে তার একমাত্র উপায় বাস্তবের কঠিন জমিতে। এই অন্ধকারের মধ্যেও সমাজ সংস্কৃতির নানা পরিসরে নতুন ভাবনা এবং নতুন সৃষ্টির যে সব উদ্যোগ জারি রয়েছে, বিশেষত তরুণ প্রজন্মের কিছু মানুষ যে উদ্যোগে শামিল হয়েছেন, তাঁদের মধ্যে থেকেই উঠে আসতে পারে নতুন বছরের, এবং নতুন যুগের, উত্তরণের পথ। রবীন্দ্রনাথও সম্ভবত তেমনটাই মনে করতেন।