মুখ্যমন্ত্রী জানাইয়াছেন, কাজের সন্ধানে আর ভিন্রাজ্যে যাওয়ার প্রয়োজন নাই, এই রাজ্যেই বিভিন্ন প্রকল্পে কর্মসংস্থান হইবে। যে অনুভূতি হইতে মুখ্যমন্ত্রী কথাটি বলিয়াছেন, তাহা অভিভাবকের— মা অথবা বড় দিদি যেমন ভাবেন, ঘরে যাহা হউক দুই মুঠা অন্নের সংস্থান হইয়া যাইবে, বাছার আমার বিপদের মুখে পড়িয়া কাজ নাই। কিন্তু, রাজ্যের প্রশাসনিক প্রধানের শুধু এই মমত্ববোধ থাকিলেই চলে না, অর্থনীতির বাস্তবজ্ঞানটিও থাকা প্রয়োজন। শ্রমিকরা কেহ দেশ দেখিবার তাড়নায় ঘর ছাড়েন নাই— এই রাজ্যে কাজ করিয়া যে মজুরি জুটে, তাহা যথেষ্ট নহে বলিয়াই তাঁহারা ভিন্রাজ্যে পাড়ি দিয়াছেন, আয়ের খোঁজে। তাঁহারা যখন ঘর ছাড়িয়াছিলেন, তখনও রাজ্যে হাঁস-মুরগি প্রতিপালনের ব্যবস্থা ছিল; মুখ্যমন্ত্রী অন্য যে কাজগুলির কথা ভাবিতেছেন, সেইগুলিও নিতান্ত বিরল ছিল না। তাহা যথেষ্ট নহে বলিয়াই যে শ্রমিকরা ভিন্রাজ্যে কাজের খোঁজে গিয়াছিলেন, এখন সেই কাজের আকর্ষণেই তাঁহারা ঘরে থাকিবেন, এমন ভাবনার গোড়ায় গলদ প্রকট। বাহিরে বিপদ তীব্র হইলে তাঁহারা সাময়িক ভাবে রাজ্যে ফিরিতে পারেন; কিছু দিনের জন্য যাহা জুটে, তাহাই করিতে পারেন। কিন্তু যুক্তি বলিতেছে, তাহা একটি দীর্ঘমেয়াদি সুস্থায়ী বন্দোবস্ত হইতে পারে না। মুখ্যমন্ত্রীর সদিচ্ছাকে সম্মান জানাইয়া বলিতে হয়, বাস্তবকে অস্বীকার করিয়া নীতি নির্ধারণ করা চলে না। কোনও সদিচ্ছাই বাস্তববোধের অভাবের ঘাটতি পূরণ করিতে পারে না।
মুখ্যমন্ত্রী স্বীকার করুন বা না-ই করুন, সমস্যাটি পশ্চিমবঙ্গের অর্থব্যবস্থার কাঠামোগত। এই রাজ্যে বৃহৎ শিল্প নাই, অর্থব্যবস্থাটি ক্রমে আরও বেশি করিয়া সরকারি সাহায্য বা অনুদাননির্ভর হইয়া উঠিতেছে। ফলে, সার্বিক ভাবেই রাজ্যে শ্রমের চাহিদা কম; বাজারের নিয়ম মানিয়া মজুরিও কম। এই পরিস্থিতিতে কর্মসংস্থান বাড়াইতে হইলে তাহার একমাত্র পথ, সরকারকে আরও বেশি টাকা খরচ করিতে হইবে। কিন্তু সেই পথেও কাঁটা— স্বাস্থ্যসাথী ও লক্ষ্মীর ভান্ডারের জন্য অর্থ সংস্থান করিতেই সরকারের কালঘাম ছুটিতেছে। অতএব, থোড়-বড়ি-খাড়ার পরিবর্তে খুব বেশি হইলে খাড়া-বড়ি-থোড়ের ব্যবস্থা হইতে পারে। মুখ্যমন্ত্রীর সমাধানসূত্রটি প্রকৃত প্রস্তাবে সেই ব্যবস্থার কথাই বলিতেছে। স্বভাবতই তাহাতে সমস্যা মিটিবে না। রাজ্যের শ্রমিকদের জন্য যদি রাজ্যের পরিসীমাতেই কর্মসংস্থান করিতে হয়, তাহার একমাত্র পথ শিল্পায়ন। সেই কাজটি এক দিনের নহে। কিন্তু, কোনও একটি মুহূর্তে যাত্রা শুরু করিতে হয়। বর্তমান সঙ্কটটিই সেই সূচনামুহূর্ত হইতে পারে।
যত দিন না রাজ্যে প্রকৃত কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হইতেছে, তত দিন অবধি মানিয়া লইতে হইবে যে, শ্রমিকরা কাজের খোঁজে ভিন্রাজ্যে যাইবেন। এই কথাটি মানিয়া লইলে ভিন্রাজ্যে পশ্চিমবঙ্গের শ্রমিকদের স্বার্থরক্ষার প্রশ্নটিকে রাজ্য সরকার অধিকতর গুরুত্ব দিতে পারে। প্রবাসে যাহাতে রাজ্যের শ্রমিকরা অসহায় না হইয়া পড়েন, তাহার জন্য সংশ্লিষ্ট রাজ্যগুলির উপর চাপ বজায় রাখা সরকারের কাজ। বেঙ্গালুরুতে বাঙালি পরিযায়ী শ্রমিকরা সংগঠিত হইবার চেষ্টা করিতেছেন। অন্য রাজ্যেও নিশ্চয়ই করিবেন। এই প্রচেষ্টাগুলিকে সরকারি স্বীকৃতি দেওয়া বিধেয়। অন্য দিকে, ভিন্রাজ্যে যাইবার চেষ্টায় রাজ্যের শ্রমিকরা যেন দালালের খপ্পরে না পড়েন, তাহা নিশ্চিত করা; পরিযায়ী শ্রমিকদের তালিকা তৈরি করা; শ্রমিক ও তাঁহাদের পরিবারের মধ্যে যোগসূত্র বজায় রাখা— এই কাজগুলিও সরকারকে করিতে হইবে। পরিযায়ী শ্রমিক হইলেই যে নিরাপত্তাহীন পরিস্থিতিতে কাজ করিতে হইবে— এই বিচিত্র সমীকরণটিকে ভাঙিবার জন্য সরকারি উদ্যোগ প্রয়োজন। রাজ্যেই কর্মসংস্থানের অলীক চেষ্টায় এই কাজগুলিতে ঘাটতি হইলেই বরং শ্রমিকের ক্ষতি।