ফাইল চিত্র।
চালুনি সুচের ছিদ্রান্বেষণে মাতে, পোড়া হাঁড়ি বিদগ্ধ কেটলিকে তাহার রং লইয়া কটাক্ষ করে— লজ্জাহীন পরনিন্দার স্বরূপ বুঝাইতে এই সকল উপমা বহুব্যবহারে জীর্ণ হইয়াছে। এই ধারায় নূতন সংযোজন ঘটাইলেন নরেন্দ্র মোদী, অমিত শাহ এবং তাঁহাদের পারিষদবর্গ। ১৯৭৫ সালের ২৫ জুন প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গাঁধী ভারতে অভ্যন্তরীণ জরুরি অবস্থা ঘোষণা করিয়াছিলেন। ছেচল্লিশ বছর পরে সেই দিনটিকে উপলক্ষ করিয়া অনেকেই গণতন্ত্রের বিপদ লইয়া আলোচনা করিয়াছেন, সেই বিপদ প্রতিহত করিবার জন্য সজাগ ও সতর্ক থাকিবার প্রয়োজন স্মরণ করাইয়া দিয়াছেন, ভারতীয় গণতন্ত্রের ইতিহাসে জরুরি অবস্থা নামক কলঙ্কের জন্য আক্ষেপ এবং ইন্দিরা গাঁধীর প্রতি ধিক্কার জানাইয়াছেন। এবং, সেই নিন্দাবাদে যোগ দিয়াছেন কেন্দ্রীয় শাসকরাও। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর রায়: সত্তরের দশকের সেই কালপর্বটি ছিল সংবিধান ও গণতন্ত্রের মর্যাদাহানির এক অন্ধকার যুগ। নাটকীয়তার পরম ভক্ত প্রধানমন্ত্রী ইহার সহিত যোগ করিয়াছেন বিস্ময়বিমূঢ় প্রশ্ন: কী সব জিনিস নিষিদ্ধ হইয়াছিল, বিশ্বাস করিতে পারেন?
নিষিদ্ধের তালিকাটিতে অবিশ্বাস্য সত্যই বিস্তর। অন্যে পরে কা কথা, স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও রক্ষা পান নাই, সরকারি বেতারে তাঁহার বিবিধ গান ও কবিতার প্রচার বন্ধ ছিল, এমনকি পত্রপত্রিকায় ‘চিত্ত যেথা ভয়শূন্য’ ছাপিবার অনুমতি দেন নাই পশ্চিমবঙ্গের তথ্য-সংস্কৃতি দফতরের অধিষ্ঠাতা মন্ত্রিবর। এই সকল বাধানিষেধ হিমশৈলের চূড়ামাত্র, গণতন্ত্র ও সংবিধানের উপর সে-দিন স্বাধিকারপ্রমত্ত রাষ্ট্রশক্তির যে স্বৈরাচারী আক্রমণ নামিয়া আসে, তাহা ইতিহাসে কলঙ্কের অক্ষরে চিরস্থায়ী হইবে। সেই ইতিহাস হইতে শিক্ষা লইয়া রাষ্ট্রযন্ত্রের চালকদের দায়িত্ব গণতন্ত্রের স্বাস্থ্য ও মর্যাদার সুরক্ষায় নিরন্তর তৎপর থাকা। জরুরি অবস্থার পরবর্তী অর্ধ শতকে ভারতীয় রাষ্ট্র সেই দায়িত্ব যথাযথ পালন করিয়াছে, এমন কথা বলা চলে না। বিভিন্ন দল ও গোষ্ঠীর শাসকরাই নানা ভাবে ক্ষমতার অপব্যবহার করিয়াছেন, গণতন্ত্র লাঞ্ছিত হইয়াছে।
কিন্তু নরেন্দ্র মোদীর সাত বছরের রাজত্বে সেই লাঞ্ছনা এক অভূতপূর্ব আকার ধারণ করিয়াছে। স্বৈরতন্ত্রী আধিপত্যবাদের অজস্র নিদর্শন আক্ষরিক অর্থে প্রতি দিন প্রতিটি ক্ষেত্রে প্রকট। সেই সব বহুচর্চিত দৃষ্টান্তের তালিকা রচনা নিষ্প্রয়োজন। বর্তমান জমানার বৈশিষ্ট্য ইহাই যে, জরুরি অবস্থা ঘোষণা না করিয়াই গণতন্ত্রের মূলে আঘাত করিবার প্রক্রিয়াটি আজ ক্রমশ প্রবল হইতে প্রবলতর। জরুরি অবস্থার এই নবকলেবরের মূলে রহিয়াছে গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলিকে শাসকের আজ্ঞাবাহী যন্ত্রে পরিণত করিবার বন্দোবস্ত। বর্তমান জমানায় সেই বন্দোবস্তটি পনেরো আনা সম্পন্ন। সিবিআই ইত্যাদি ‘তোতাপাখি’র কথা বলা বাহুল্যমাত্র, মানবাধিকার কমিশনের মতো ‘নিরপেক্ষ’ নজরদারেরাও দৃশ্যত রাষ্ট্রের নজরবন্দি। চতুর্থ স্তম্ভের অধিকাংশ পরিসরই দুর্বল, অনুগত, সন্ত্রস্ত। নির্বাচন কমিশনের নিরপেক্ষতার নমুনা পশ্চিমবঙ্গের সাম্প্রতিক ভোটপর্বে নাগরিকের সম্মুখে থরে থরে পরিবেশিত হইয়াছে। বিচারবিভাগের কিছু কিছু স্বাধীন এবং ন্যায়নিষ্ঠ নির্দেশ এখনও এক আনা আশা জাগাইয়া রাখিয়াছে— পদ্মপত্রে দুই-চারিটি জলকণার মতো। ইতিমধ্যে কেন্দ্রীয় সরকার বিভিন্ন দমনমূলক আইনে নিপীড়নের নূতন অস্ত্র সংযোজন করিয়াছে, যেমন ইউএপিএ সংশোধন করিয়া ব্যক্তিকে সন্ত্রাসবাদী বলিয়া চিহ্নিত করিবার ক্ষমতা এখন রাষ্ট্রের করতলগত। রাষ্ট্রদ্রোহ আইনের অপব্যবহার যথেচ্ছাচারে পরিণত, সরকারি নীতি ও আচরণ সম্পর্কে প্রশ্ন তুলিলেও লাঞ্ছনা, হেনস্থা এবং কারাবাসই এখন ‘স্বাভাবিক’ পরিণাম। জরুরি অবস্থাকে অস্বাভাবিক বলিয়া চেনা যাইত, এখন স্বাভাবিক অবস্থাই এমন যে, জরুরি অবস্থা ঘোষণার আর প্রয়োজন নাই।