প্রতিনিধিত্বমূলক ছবি
কালনার ছাড়িগঙ্গা অনেক দিন ধরেই বিপন্ন। বিপদ তার একার নয়। সুজলা বঙ্গভূমির বহু নদ নদী খাল বিলের মতোই, নিম্নবঙ্গে ছড়িয়ে থাকা আরও অনেক কাটিগঙ্গা বুড়িগঙ্গা ছাড়িগঙ্গার মতোই, পূর্ব বর্ধমান জেলার এই জলরাশিও ক্রমশ ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর হয়ে আসছে। জলাশয়ের তলদেশে জমে উঠেছে পলি, তার বুকে চলেছে কচুরিপানার নিরন্তর সাম্রাজ্য বিস্তার। অধুনা এই সমস্যা এক বিপুল আকার ধারণ করেছে। আর তার অমোঘ পরিণামে সেখান থেকে মুখ ফিরিয়েছে পরিযায়ী পাখিরা। প্রতি বছর শীতকালে তারা ঝাঁক বেঁধে আসত, দূর দেশের অতিথিদের কয়েক মাসের ঠিকানা হত এই ছাড়িগঙ্গা, পাখিরালয়ের নাম ছড়িয়েছিল দেশে বিদেশে। যত দিন পরিবেশ অনুকূল থাকে, পরিযায়ী পাখিরা বারংবার সময় মতো একই ঠিকানায় আসে, থাকে, তার পরে সময় হলেই স্বভূমিতে ফিরে যায়। আবহমান কাল যাবৎ তাদের জীবনবৃত্ত এই শৃঙ্খলাতেই আবর্তিত হয়ে আসছে, সেই আবর্তনের সূত্র ধরে দুনিয়া জুড়ে রচিত হয়েছে পাখিদের পরিযাণের মানচিত্র, এ-কালের বিমান চলাচলের আকাশ-চিত্র তার তুলনায় নিতান্তই অর্বাচীন এবং যান্ত্রিক। আবার, আবহমান কাল ধরে দেখা গিয়েছে যে, অনুকূল পরিবেশ প্রতিকূল হয়ে উঠলেই পাখিরা দ্রুত সরে যায় অন্য ঠিকানার খোঁজে, বিকল্প খুঁজে না পেলে পরিযাণের পথ ক্রমে পাল্টে যায় তাদের, পাল্টে যায় চকা-নিকোবরদের অভিযানের মানচিত্র। পরিবেশ যেমন পরিবর্তিত হয়, পরিযায়ী পাখিরাও সেই ভাবেই মানিয়ে নিতে চায়, পরিবর্তনের সঙ্গে তাল রেখে জীবনযাপনের চেষ্টা করে, এটাই তাদের স্বভাব বা প্রকৃতি।
এই প্রকৃতির মহিমা কতখানি মর্মস্পর্শী হতে পারে, তার এক নজির দেখা গিয়েছে কালনার ওই এলাকাতেই। সেখানে সরকারি কর্মীদের একটি আবাসনের পিছন দিকে এক জলাশয় আছে, গাছগাছালিতে ঘেরা শেওলায় ঢাকা সেই জলাশয়ের পরিবেশ সচরাচর নির্জন, শান্ত। ইদানীং শীতের শুরু থেকে সেখানেই ভিড় জমাচ্ছে পরিযায়ী পাখির দল। ছাড়িগঙ্গার দুর্দশা দেখে তারা নিশ্চয়ই খোঁজ করেছে আশেপাশে কোথায় বিকল্প বসতি গড়া যায়, তেমন সন্ধান না মিললে হেথা নয় অন্য কোথা অন্য কোনওখানে বলে আবার আকাশে ডানা মেলতে হবে। অতঃপর এই ছায়াসুনিবিড় শান্তির নীড়টি খুঁজে পেয়ে মহানন্দে সেখানে নেমেছে। এই আবাসে যদি কোনও উপদ্রব না ঘটে, বঙ্গীয় শীতের অল্প কয়েকটি সপ্তাহ যদি সেখানে কাটাতে পারে তারা, তবে পরের বছরে হয়তো সোজাসুজি সেখানেই অবতরণ করবে। নতুন ঠিকানাকেই মানিয়ে নেবে, নিজের করে নেবে। কেবল পাখি নয়, রকমারি প্রাণিকুলের এই মানিয়ে নেওয়ার স্বভাব প্রতিনিয়ত নিজেকে সহস্রধারে চোখের সামনে মেলে ধরছে। শুধু ঠিকানা নয়, পরিযাণের পথ নয়, খাদ্যাভ্যাস থেকে শুরু করে দৈনন্দিন জীবনযাপনের রীতি অবধি সব কিছু তারা পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতির পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে যথাসাধ্য পাল্টে নেয়। এই ভাবেই অসংখ্য প্রজাতি যত দূর সম্ভব, যত ভাবে সম্ভব, প্রকৃতি-পরিবেশের সঙ্গে নিজেদের মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে চলে।
মানুষ নামক প্রজাতিটির রীতি সম্পূর্ণ বিপরীত। সে প্রকৃতির সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নেয় না, প্রকৃতিকে নিজের প্রয়োজন অনুসারে পাল্টে দেয়। দীর্ঘকাল ধরেই, এক অর্থে ‘কৃষি সভ্যতা’র সূচনা থেকেই এই ধারা চলে আসছে, তবে গত দুই বা আড়াই শতাব্দীতে শিল্পবিপ্লবের অভিঘাতে তার বেগ এবং বিস্তার দুই-ই অভূতপূর্ব মাত্রা অর্জন করেছে, বিশেষত গত কয়েক দশকে প্রকৃতি এবং পরিবেশের উপর নির্বিচার আক্রমণের যে লীলা এই প্রজাতি জারি রেখেছে, তার পরিণামে আজ এই গ্রহ এসে দাঁড়িয়েছে সর্বনাশের কিনারায়, বাস্তবিকই ধ্বংসের মুখোমুখি আমরা। পরিবেশের সঙ্গে নিজের সংযোগকে স্বীকার করে, সম্মান করে, তার সঙ্গে মানিয়ে চলার আদর্শকে ‘সভ্যতা’-র গর্বে গর্বিত, ‘উন্নয়ন’-এর লক্ষ্যে ধাবিত এ-কালের মানুষ সদম্ভে অস্বীকার করেছে। অথচ অসংখ্য প্রজাতির জীবনযাত্রার প্রতি মনোনিবেশ করলে সে দেখত, তার ক্ষমতার দাপটে বিধ্বস্ত পৃথিবীর বুকে বেঁচে থাকার জন্য তারা কী প্রাণপণ লড়াই চালাচ্ছে, ছাড়িগঙ্গা ছেড়ে আবাসনের জলাশয়ে শরণার্থী ওই দূরাগত বিহঙ্গেরা যে লড়াইয়ের নজির। আশার কথা এইটুকুই, ওই অঞ্চলের অধিবাসীরা তাদের লড়াইয়ের পাশে দাঁড়িয়েছেন, নজর রাখছেন যাতে তারা নতুন ঠিকানায় শান্তিতে থাকতে পারে, তাদের কেউ বিরক্ত বা বিপন্ন না করে। এই স্বাভাবিক সুচেতনায় ভরসার কারণ আছে বইকি।