সম্প্রতি এক প্রবীণ চিত্রপরিচালকের প্রয়াণকে ঘিরে বাঙালির একটি দীর্ঘসঞ্চিত পরিতাপ নতুন করে বেগবতী হয়ে উঠেছে। তরুণ মজুমদারকে নিয়ে জনপরিসরে যত আলোচনা চলছে, তার মধ্যে একটি অভিন্ন হাহাকারের সুর স্পষ্ট— পর্দায় রসিয়ে গল্প বলার শেষ প্রতিনিধি চলে গেলেন। সিনেমায় জমাটি গল্প হারিয়ে যাওয়ার বৃহত্তর শোকের পটে ব্যক্তি তরুণ মজুমদারের জীবনাবসানকে স্থাপন করেছে বাঙালি। এই যৌথ হাহাকার কোনও আত্মসমীক্ষণের পথ খুঁজে নেবে কি না, সেটা ভবিষ্যতের প্রশ্ন। কিন্তু উত্তরণের দিশা যদি পেতে হয় আদৌ, তবে কোন কানাগলিতে বাঙালির গল্পবলিয়ে সত্তাটি দিগ্ভ্রষ্ট হল, সেটা তলিয়ে দেখা দরকার। ভারতীয় চলচ্চিত্রের ইতিহাসে গল্প বলার মুনশিয়ানায় দীর্ঘ কাল বাংলার স্থানটিই ছিল পয়লা। স্বাধীনতা-পূর্ব যুগে তো বটেই, স্বাধীনতার পরেও। দেশভাগ বাংলা ছবির বাজার সঙ্কুচিত করে, আঘাত হানে আর্থিক পরিকাঠামোয়। কিন্তু দক্ষতায় কমতি হয়নি। ভাঙা বুকের পাঁজর নিয়েই অনেক দিন অবধি বাংলা ছবি হিন্দির চাকচিক্য আর দক্ষিণের আড়ম্বরের সঙ্গে পাঞ্জা লড়ে গিয়েছে। সেটা সম্ভব হয়েছে তার গল্পের জোরে, গল্প বলার জোরে, গল্পকে মূর্ত করে তোলায় পটু কলাকুশলীদের জোরে।
অথচ চলচ্চিত্র যে আদৌ গল্প বলবে, সেটা কোনও স্বতঃসিদ্ধ ঘটনা ছিল না। জন্মলগ্নে চলচ্চিত্র ছিল কিছু মুহূর্তের সমাহার, চলমান ভানুমতীর খেল। সে যে অল্প দিনের মধ্যেই অফুরন্ত গল্পের ঝাঁপি খুলে বসবে, সেই শক্তি তাকে অর্জন করতে হয়েছে। চাহিদা আর জোগানের অঙ্ক মেনে নিজেকে গড়েপিটে নিতে হয়েছে। দ্রুতই ঘটে গিয়েছিল এই পালাবদল। বাংলা উপন্যাসে ধরা আছে এই ক্রমবিকাশের ঝলক। অপু যখন কলকাতায় এল, তখন তার অন্যতম আগ্রহের বিষয় বায়োস্কোপ। স্কুলে পড়তে সে যে বায়োস্কোপ দেখেছে, তাতে গল্প নেই। কিন্তু প্রথম মহাযুদ্ধের কলকাতায় এসে সে গল্প বলা বায়োস্কোপ দেখতে চায়। অপুর যত দিনে বিয়ে হয়েছে, বাংলা ছবিও গল্প বলতে শিখেছে। সবাক যুগ আগতপ্রায়। ক’দিনের মধ্যেই সে নিউ থিয়েটার্সের হাত ধরে ভারত-জয়ে বেরোবে, ছবিতে গল্প বলায় বাঙালির আধিপত্য সুপ্রতিষ্ঠিত হবে। কাকতালীয় নয় সেটা, বঙ্গীয় রেনেসাঁসেরই উত্তরাধিকার। সেই বিজয় অভিযান অতীত হয়েছে বহু কাল। কিছু বিচ্ছিন্ন আলোকবিন্দু বাদ দিলে বাংলা ছবির সামগ্রিক চেহারাটি আপাতত হতশ্রী। ফলত তরুণ মজুমদার বা সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায় বা সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়দের প্রয়াণ ইদানীং ব্যক্তির প্রস্থানকে ছাপিয়ে এক গৌরবময় অতীতের চিহ্ন বিলীন হওয়ার বেদনা বহন করে।
কিন্তু শুধুই স্মৃতিমেদুর চর্বিতচর্বণ না দেয় মুক্তির ইঙ্গিত, না করে ব্যর্থতার ময়নাতদন্ত। অতীতবিলাসী হাহুতাশ ভুলিয়ে দেয় গোড়ার কথাটিই যে, গল্প বলায় বাঙালির ব্যুৎপত্তি তৈরি হয়েছিল নির্দিষ্ট ঐতিহাসিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক কার্যকারণের ভিত্তিতে। আধুনিক শিক্ষা ও সংস্কৃতির প্রসার, সমাজ সংস্কার আন্দোলন, রাজনৈতিক চেতনার উন্মেষ সেই বাঙালিকে নির্মাণ করেছিল। আজকের বাংলায় অর্থনীতি ভঙ্গুর, মেধা পলায়নী, মনন দীন, রাজনীতি আত্মঘাতী। বঙ্গীয় সাহিত্য-নাট্য-সঙ্গীতের গুণগত অবস্থান উৎকর্ষের ধ্রুপদী মাপকাঠি থেকে বহু ক্রোশ দূরে। ভাল গল্প ভাল করে বলার দায় বাংলা ছবি একাই বা নেবে কী ভাবে? এখন ভাবলে অলীক মনে হবে সেই সব দিন, যখন গল্পের অভাব নয়, বরং অতিরিক্ত সাহিত্য-নির্ভরতাই ছবিকে ‘বই’ বলা চালু করেছিল। ‘ভাল গল্প মানেই কি ভাল ছবি?’ সত্যজিৎ রায়কে কলম ধরে বোঝাতে হয়েছিল দুয়ের তফাত। গল্প বলার টেকনিক রপ্ত করার কাজ সেরে উৎকর্ষের উচ্চতর শিখর জয়ের সাধনায় তখন লিপ্ত ছিল বাঙালি। আপাতত সে সবই হারানো সুর! হীনবর্ণ বঙ্গসংস্কৃতির মোড় ঘোরার কাহিনি রচিত না হলে নিস্তার নেই।