Sedition

উত্তরাধিকার

স্বাধীনতার পঁচাত্তর বৎসর পরেও এমন ঔপনিবেশিক আইনের অস্তিত্ব থাকিবে কেন, সেই প্রশ্ন তুলিয়াছে দেশের সর্বোচ্চ আদালত।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৩ নভেম্বর ২০২১ ০৭:৩২
Share:

শতবর্ষ পূর্বের প্রতিবেদন জানাইতেছে, দেশদ্রোহের দায়ে কুমিল্লা হইতে গ্রেফতার হইয়াছেন ধূমকেতু পত্রিকার সম্পাদক কাজী নজরুল ইসলাম। ১৮৭০ সালে ভারতীয় দণ্ডবিধিতে প্রশাসক টমাস ব্যাবিংটন মেকলে রচিত ১২৪এ ধারা যুক্ত হয়। তাহা বলিয়াছিল, মৌখিক বা লিখিত রূপে, অথবা ইঙ্গিতেও কোনও ব্যক্তি যদি সরকারের বিরুদ্ধে ঘৃণা বা অবমাননা প্রকাশ করেন, অথবা হতাশা জাগাইয়া তোলেন, তবে উহা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। ঔপনিবেশিক আমলে শাসন কায়েম রাখিতে— স্বাধীনতা সংগ্রামের কণ্ঠরোধ করিতে— উহা যথেচ্ছ ব্যবহৃত হইত। ব্রিটিশ আর নাই, কিন্তু আইনটি রহিয়াছে। এবং, তাহার প্রয়োগও বর্তমান, ক্রমবর্ধমান। চিত্রপরিচালক আয়েশা সুলতানা, জলবায়ু আন্দোলনকারী দিশা রবি, সাংবাদিক সিদ্দিক কাপ্পান— যাঁহার কর্মকাণ্ডেই সরকার অস্বস্তিতে পড়িয়াছে, তিনিই ‘দেশদ্রোহী’ সাব্যস্ত হইয়াছেন। এমনকি ক্রিকেট খেলায় পাকিস্তানের জয়ে কেহ আনন্দ প্রকাশ করিলেও সরকারবাহাদুর দেশদ্রোহের নালিশ ঠুকিয়াছে। বিরুদ্ধমত চাপা দিতে আজও হাতিয়ার সেই আইন, আপনার স্বার্থে উহাকে কাজে লাগাইতে সমান সক্রিয় রাষ্ট্রপক্ষ। উপনিবেশের অমোঘ উত্তরাধিকার।

Advertisement

এই প্রসঙ্গে সুপ্রিম কোর্টের সাম্প্রতিক পর্যবেক্ষণটি প্রণিধানযোগ্য। দেশদ্রোহ আইন বিষয়ে আদালতের খেদোক্তি, ইহা এমন এক করাত, এক টুকরা কাঠ কাটিবার নিমিত্ত যাহার জন্ম হইলেও, সম্পূর্ণ অরণ্য হাসিল করিয়া দেয়। দেখা যায়, আইন যাঁহাদের হস্তগত— যাঁহারা আইনের রক্ষাকর্তা— তাঁহাদের অপছন্দের কিছু ঘটিলেই এই ধারার প্রয়োগ ঘটিয়া যায়। প্রয়োগকারীর জবাবদিহির দায় না থাকিবার ফলে অপপ্রয়োগের ক্ষেত্রটিও বিস্তর। ক্ষমতাসীন দল যাঁহার কথা শুনিতে চাহিবে না, তাঁহার বিরুদ্ধেই এই আইন কাজে লাগানো সম্ভব— অতএব ইহা নাগরিকের বাক্‌স্বাধীনতার পরিপন্থী; রাষ্ট্রের প্রতি প্রশ্নশীল নাগরিকের পক্ষে অতি বিপজ্জনক। স্বাধীনতার পঁচাত্তর বৎসর পরেও এমন ঔপনিবেশিক আইনের অস্তিত্ব থাকিবে কেন, সেই প্রশ্ন তুলিয়াছে দেশের সর্বোচ্চ আদালত।

শতবর্ষ পূর্বের একটি সংবাদ এমন সমসাময়িক হইয়া উঠিলে বুঝিয়া লইতে হয়, স্বাধীনতা অর্জনের একটি বড় উদ্দেশ্য এই পঁচাত্তর বৎসরেও সাধিত হয় নাই। শত ‘অমৃত মহোৎসব’ পালনেও এই সত্যটি ঢাকা পড়িবে না যে, শাসকের অন্তরটি এখনও ঔপনিবেশিকতার সুরেই বাঁধা। তাহার মূল উদ্দেশ্য দমন— মানুষের ক্ষোভ, প্রশ্ন, বিরুদ্ধ মত, যাহাই শাসকের অবস্থানের পরিপন্থী, তাহাকেই দমন করিয়া রাখা। দেশদ্রোহ আইন সেই দমননীতিরই আয়ুধ। ফারাক হইল, ঔপনিবেশিক শাসকরা প্রজা দমন করিতেন; স্বাধীন ভারতের শাসকরা দমন করেন নাগরিকদের। সেই নাগরিকদের, যাঁহাদের স্বশাসনের অধিকারের স্বীকৃতিই স্বাধীনতার সর্বোত্তম প্রাপ্তি হিসাবে গণ্য। গণতন্ত্রের অনুশীলনের অবিচ্ছেদ্য শর্ত হইল নাগরিকের ভিন্ন মত প্রকাশের অধিকার। স্বাধীন দেশের শাসকরাও সেই অধিকারটি স্বীকার করিতে ঔপনিবেশিক পূর্বসূরিদের ন্যায় নারাজ, ইহা ভারতীয় গণতন্ত্রের পক্ষে সুসংবাদ হইতে পারে না। শতবর্ষের ব্যবধানেও যে মানসিকতা পাল্টায় না, তাহার মূলে পৌঁছাইয়া পরিবর্তনের চেষ্টা করা জরুরি।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement