অবশেষে কি ঘুম ভাঙল কলকাতা পুরসভার? তাদের দ্বারা পরিচালিত স্কুলগুলির দশা দীর্ঘ দিন ধরেই শোচনীয়— শিক্ষাদানের মান ভাল নয়, ভবনগুলি ভেঙে পড়ছে, বাড়ছে স্কুলছুটের সংখ্যাও। সংবাদে প্রকাশ, ধুঁকতে থাকা স্কুলগুলির সংস্কারের জন্য সম্প্রতি দিল্লি থেকে ঘুরে এলেন মেয়র পারিষদ (শিক্ষা)-সহ শিক্ষা দফতরের তিন আধিকারিক। দিল্লির উপমুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকও করেছেন তাঁরা। দিল্লি সরকার গত কয়েক বছরে যে ভাবে সেখানকার সরকারি শিক্ষার হাল বদলে দিয়েছে, যার ফলে বহু মধ্যবিত্ত নিজের সন্তানকে বেসরকারি স্কুলের বদলে সেখানে ভর্তি করছেন, তা দেশে দৃষ্টান্তস্বরূপ। সেরা উদাহরণ থেকে শিক্ষা নেওয়া কর্তব্য— সে কারণে কলকাতা পুরসভা প্রশংসার্হ। তাদের শিক্ষাখাতে বরাদ্দ কম নয়, অতএব এই মডেল ব্যবস্থা থেকে শিক্ষাগ্রহণ করতে পারলে তা প্রয়োগের কথা ভাবা হয়তো কঠিন হবে না। পুরবাসীও স্কুলশিক্ষা নিয়ে আশান্বিত হবেন।
এই কাজে প্রশাসন তথা রাজনীতির নেতৃবর্গের মনোভাব পরিবর্তনটি যদিও ভিত্তিস্বরূপ। যাঁদের অর্থের জোর নেই, তাঁদের বেছে নেওয়ার ক্ষমতাও থাকবে না— এটিই শাসকবর্গের সাধারণ মানসিকতা। তাঁদের ধারণটি এমনই যে, যাঁরা টাকার অভাবে সন্তানদের বেসরকারি স্কুলে পাঠাতে পারছেন না, তাঁরা সরকারি স্কুলে যে পরিষেবা পাবেন সেটাই গ্রহণ করতে হবে, ভাল-মন্দ নির্বাচন করার ক্ষমতা তাঁদের থাকবে না। শাসকবর্গ যদি জনসাধারণকে সত্যিকারের নাগরিক বলে মনে করে, তা হলে এই দাক্ষিণ্যের মনোভাবটি পরিত্যাজ্য। শিক্ষা সংবিধানস্বীকৃত প্রতিটি শিশুর প্রাথমিক অধিকার। সকলের জন্য সেরা মানের শিক্ষার বন্দোবস্ত করা সরকারেরই দায়িত্ববিশেষ। বিশেষত স্মর্তব্য, অতিমারির সময়ে বহু অভিভাবকই বেসরকারি স্কুলের মোটা বেতন দিতে অপারগ, তাই সরকারি বিকল্প এই মুহূর্তে আরও বেশি প্রয়োজনীয়। বোঝাই যায়, সরকারি স্কুলের পরিকাঠামো এবং অন্যান্য অবস্থা দেখে তাঁরা সন্তানদের সেখানে পাঠাতে ভরসা পাচ্ছেন না। এই ক্ষেত্রে পুরসভার উদ্যোগটি অত্যন্ত সময়োপযোগীও বটে।
আরও একটি প্রক্রিয়াগত বিষয় মাথায় রাখতে হবে। স্কুলশিক্ষা সমাজের ভবিষ্যৎ, সে জন্য সার্বিক সামাজিক উদ্যোগও অতি গুরুত্বপূর্ণ। এই সঙ্কট যে হেতু এক দিনের নয়, তা মেটাতেও বড় পরিকল্পনা প্রয়োজন, বহু বিশেষজ্ঞকে যুক্ত করা বিধেয়। অতএব, শিক্ষাব্যবস্থা সংস্কারের উদ্যোগটি সরকারি হলেও সেই কাজ সম্পন্ন করার জন্য অন্য কোনও সংস্থা বা ব্যক্তিবর্গের সাহায্য নেওয়া যেতেই পারে। উদ্যোগটি সরকারি বলে সেই প্রক্রিয়াও সরকারি বিভাগ বা আধিকারিকেরাই চালাবেন, এমন কোনও বাধ্যবাধকতা নেই। বস্তুত তার বিপদও অনেক— লাল ফিতের ফাঁসে আটকে যেতে পারে জরুরি সংস্কার। খেয়াল করতে হয়, দিল্লি সরকারও এক বিশেষজ্ঞ শিক্ষাবিদকে উপদেষ্টা নিয়োগ করে সংস্কারের কাজ শুরু করেছিল। প্রশ্নটি যখন শিক্ষাকে ঢেলে সাজাবার, দায়িত্বটি তখন সহজ নয়, তাই সেই বিষয়ে সবচেয়ে কুশলী ব্যক্তিবর্গের হাতেই কর্তব্য সম্পাদিত হওয়া বাঞ্ছনীয়। বিষয়টিতে সরকারের নজরদারি থাকতে হবে, কিন্তু সরকার-বহির্ভূত বিকল্পগুলি খোলা না রাখলে কাজটি করার রাস্তা খুলবে না।