Rape Victims

ভস্মীভূত

বগটুইতে দেহ শনাক্তকরণ, পোস্ট মর্টেম প্রক্রিয়ার ভিডিয়ো, ডিএনএ সংগ্রহ প্রভৃতি যথাযথ নিয়ম মেনে হয়েছে কি না, সে প্রশ্ন উঠেছে।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৩ এপ্রিল ২০২২ ০৪:৫২
Share:

তার চোদ্দো বছরের দেহখানি ভস্মীভূত, তবু সেই ধর্ষিত, রক্তাক্ত বালিকা যেন চেয়ে আছে এ রাজ্যের মুখপানে। তার নীরব প্রশ্ন বাংলার প্রতিটি মানুষকে বিপর্যস্ত করছে। যিনি নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি, তাঁর পারিবারিক উৎসবও কেন এক নাবালিকার পক্ষে নিরাপদ নয়? ধর্ষিতার পরিবারকে কেন প্রবল হুমকির মুখে ফেলে অপরাধ গোপন করতে বাধ্য করা হয়? কেন নিজের এলাকায় নাবালিকা ধর্ষণের মতো জঘন্য অপরাধ নদিয়ার ওই থানা ‘জানতে পারল না’? অস্তিত্বের পরপার থেকে ওই বালিকা মনে করিয়ে দিচ্ছে, রক্তাপ্লুত শয্যায় যন্ত্রণাবিদ্ধ, আতঙ্কিত, সহায়হীন অবস্থায় সে যখন মৃত্যুর মুখোমুখি হয়েছিল, তখন তার না ছিল ন্যায় পাওয়ার আশা, না চিকিৎসার আশ্বাস। তার ভুবন জুড়ে ছিল ভয়ের অন্ধকার— ধর্ষণের কথা জানাজানি হলে ঘর পুড়ে যাওয়ার ভয়, তার ‘চরিত্র’ নিয়ে দুর্নাম ছড়ানোর ভয়, নিয়ত অপমানিত, লজ্জিত হয়ে বেঁচে থাকার ভয়। যারা ওই ভয়ের আবহকে তৈরি করছে, আর যারা তা মেনে নিচ্ছে, তারাই এ রাজ্যে ধর্ষণের মুক্তক্ষেত্র প্রস্তুত করে রাখছে। ধর্ষকরা সুবিধে বুঝে তাকে কাজে লাগাবে, তাতে আর আশ্চর্য কী? একের পর এক ভয়াবহ অভিযোগের প্লাবন চলেছে। কাকদ্বীপের বধূ গণধর্ষিতা, অগ্নিদগ্ধ হয়েও পুলিশে অভিযোগ করতে পারেননি তাঁর সন্তানদের উপর আক্রমণের ভয়ে। দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা জেলার আর এক গণধর্ষিতাকে পুড়িয়ে মারার চেষ্টা হল, তিনিও প্রথমে অভিযোগ জানাননি, ভয়ে, লজ্জায়। রক্তাক্ত সন্তানকে হাসপাতালে নিয়ে যেতে পারেননি বাবা-মা, ঘর পুড়ে যাওয়ার ভয়ে। আত্মীয়-স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীদের কাছে নিগৃহীত মেয়েরা ধর্ষণের কথা লুকোচ্ছেন, যতক্ষণ না অপরিমিত রক্তপাত, চূড়ান্ত অসুস্থতা প্রকৃত ঘটনাকে প্রকাশ করছে।

Advertisement

নবম শ্রেণির মেয়েটি জীবনের এই পাঠ দিয়ে গেল যে, এ রাজ্যে আইনের শাসন নেই, নারীর নিরাপত্তার অধিকার নেই, আহতের চিকিৎসার অধিকার নেই, রাজনীতির সঙ্গে মানবিক মূল্যবোধের সম্পর্ক নেই। আছে শুধু এক সর্বগ্রাসী, সর্বনাশী ভয়। এই ভয়তন্ত্রের সূচনা হয়তো মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় করেননি, কিন্তু গত এগারো বছরে যে ভাবে তাঁর প্রশাসনের প্রায় সমান্তরাল ব্যবস্থা হয়ে উঠেছে রাজনৈতিক বাহুবলীদের শাসন, তার দায় কার উপর চাপাবেন তিনি? তৃণমূলের নেতারাই বার বার নারীহিংসায় অভিযুক্ত হচ্ছেন। বর্ধমানে তুহিনা খাতুনের আত্মহত্যায় প্ররোচনা আর বগটুইয়ে অগ্নিসংযোগে গণহত্যা: দুই ঘটনাতেই শাসক দলের নেতাদের সাক্ষাৎ সংযোগ স্পষ্ট। দু’টি ক্ষেত্রেই অপরাধ ঘটেছে পুলিশ-প্রশাসনের চোখের সামনে। দুর্বৃত্ত নেতা নির্ভয়। ভয়ে জড়সড় নাগরিক, পুলিশ, সরকারি কর্মী, সরকারি চিকিৎসক।

সুবিচার পাওয়া আরও কঠিন করছে মৃত্যু-পরবর্তী তদন্তে অনিয়ম। বগটুইতে দেহ শনাক্তকরণ, পোস্ট মর্টেম প্রক্রিয়ার ভিডিয়ো, ডিএনএ সংগ্রহ প্রভৃতি যথাযথ নিয়ম মেনে হয়েছে কি না, সে প্রশ্ন উঠেছে। নদিয়ার ধর্ষণের ঘটনাটিতে বিধিভঙ্গের শুরু-শেষ খুঁজে পাওয়াই কঠিন— আহতকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়নি, ধর্ষণের অভিযোগ দায়ের হতে পাঁচ দিন পেরিয়েছে, তত দিনে দাহ হয়ে গিয়েছে দেহ, ডাক্তারের সার্টিফিকেট ব্যতিরেকে, পোস্ট মর্টেম পরীক্ষার কোনও সুযোগই না দিয়ে। সাক্ষ্যপ্রমাণ লোপাট করা, হাসপাতাল, শ্মশান, থানা সর্বত্র বিধি ভাঙা চলছে। বগটুই বা নদিয়ার ঘটনায় পঞ্চায়েত-পুলিশ-প্রশাসন ব্যবস্থার দুর্নীতি, অপদার্থতার থেকে মুখ ঘুরিয়ে থাকতে চান, এবং সমাজের নজর ঘুরিয়ে দিতে চান বলেই কি মুখ্যমন্ত্রীর কাছে আজ ধর্ষিত স্কুলপড়ুয়ার অপমৃত্যুকে ‘ছোট ঘটনা’ মনে হচ্ছে? সরকারের দোষ না খুঁজে চোদ্দো বছরের মেয়ের ‘চরিত্রদোষ’ খুঁজছেন তিনি? ওই নাবালিকার যন্ত্রণাময়, ভয়াবহ মৃত্যু কি বর্তমান সরকারের প্রকৃত চরিত্রটি উদ্ঘাটন করে দিয়ে গেল?

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement