প্রতীকী ছবি।
যে কোনও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে বিচারব্যবস্থার ভূমিকা কতখানি মৌলিক ও জরুরি, তাহা নূতন করিয়া বলিবার দরকার নাই। আর, যে সকল গণতান্ত্রিক দেশে শাসনবিভাগের দায়িত্বও অংশত বর্তাইয়া যায় বিচারবিভাগের উপর, টিকা সরবরাহের ব্যবস্থার নিদানও দিতে হয় সর্বোচ্চ আদালতকেই, সেখানে যে তাহার ভূমিকা আরও কয়েক গুণ বেশি জরুরি, ইহাও মানিতে হয়। এই পরিপ্রেক্ষিতে দেখিতে হইবে ভারতের বিচারপতিদের মধ্যে আরও অনেক বেশি প্রতিনিধিত্বমূলক বৈচিত্র আনিবার প্রস্তাবটিকে। এত বৃহৎ দেশের অতিবৈচিত্রময় সামাজিক বাস্তবকে যদি বিচারপ্রক্রিয়ায় প্রতিফলিত করিতে হয়, এবং প্রাত্যহিক নীতিপ্রণয়নে যদি বিচারবিভাগের ভূমিকা এমন ভাবেই কেন্দ্রীয় হইয়া উঠে, তাহা হইলে বিচারপতিদের নিজেদের মধ্যেও এই বৈচিত্রের ছাপ থাকা উচিত। এই প্রয়োজনবোধটি সম্প্রতি ধ্বনিত হইল সুপ্রিম কোর্টের কলেজিয়াম-সংক্রান্ত রিপোর্টে। প্রস্তাবিত হইল যে, ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, দলিত, আদিবাসী এবং অবশ্যই— নারী বিচারকদের বিচারবিভাগে আরও অধিক সংখ্যায় অন্তর্ভুক্ত করা দরকার। প্রসঙ্গত, সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের পুরুষ ছাড়া আর কেহই দেশের সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি পদে তো বৃত হন নাই বটেই, হাই কোর্ট এবং নিম্ন আদালতেও অন্যান্য গোষ্ঠীর উপস্থিতি নগণ্য। পরিস্থিতি বুঝিতে একটি হিসাব সহায়ক হইতে পারে। এই মুহূর্তে সুপ্রিম কোর্টে বিচারপতিদের মধ্যে এক জন মুসলমান, এক জন মহিলা, এক জন খ্রিস্টান, এক জন দলিত— এবং কোনও বৌদ্ধ, জৈন কিংবা আদিবাসী নাই!
অবশ্য, প্রস্তাবিত লক্ষ্য অর্জনে আগাইবার সময় একটি বিষয়ে খেয়াল রাখিতে হইবে। বিচারপতিদের গুণমানে কোনও ভাবেই আপস করা যাইবে না। বিচারপ্রক্রিয়া গণতান্ত্রিক সমাজের জন্য একটি গুরুতর স্তম্ভ, তাহার গাঁথুনি কোনও যুক্তিতেই আলগা করা উচিত হইবে না। বিচারপতিদের জ্ঞান, বুদ্ধি এবং বোধের ক্ষেত্রে উৎকর্ষই প্রধান বিবেচনা, অন্যান্য হিসাব পরে। চ্যালেঞ্জ এইখানেই। কেননা, ভারতবর্ষের সমাজের বৈষম্য এমন ভাবেই স্তরে স্তরে চারাইয়া যাহাতে অন্যান্য সংখ্যালঘু, পিছাইয়া থাকা গোষ্ঠী হইতে যোগ্য প্রার্থী পাওয়া কঠিন হইয়া দাঁড়ায়। তবে মনে রাখিতে হইবে, ‘ইনক্লুসিভনেস’ নির্মাণ একটি চলিষ্ণু পদ্ধতি— তাই এক বার যদি সুযোগক্ষেত্র উন্মোচিত হইতে শুরু করে, আশা করা যাইতে পারে যে ক্রমে যোগ্য ব্যক্তিদের পাওয়াও সহজতর হইবে। অর্থাৎ, গুণমানে আপস না করিয়া মূল নীতিটি কী ভাবে বাস্তবায়িত করা যায়, তাহা ভাবাই এখন প্রধান কাজ।
একটি গোড়ার প্রশ্ন আলোচনা করিয়া লওয়া ভাল। যাঁহারা বলিবেন, সুবিচারই লক্ষ্য হইলে বিচারপতির পরিচয় কী, তাহাতে আদৌ কী আসিয়া যায়, তাঁহাদের উদ্দেশে বলা দরকার— সামাজিক অবস্থান যে কত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, তাহা সুবিধাপ্রাপ্ত নাগরিকের পক্ষে বোঝা কঠিন হইলেও পশ্চাৎপদ গোষ্ঠী মাত্রই তাহা যথেষ্ট অবহিত। অবস্থানভেদে মানুষের দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টাইয়া যায়, আর দৃষ্টিভঙ্গির সহিত পাল্টাইতে পারে বিচারের দর্শন ও নৈতিক মাপকাঠিও। এই কারণেই গণতন্ত্রে প্রতিনিধিত্ব বিষয়টি এত গুরুতর, নতুবা কোনও গোষ্ঠীর নিজস্ব প্রতিনিধি পাইবার দাবিটির অর্থই বা কী! সুপ্রিম কোর্টের নিজের ভাষায়, বৈচিত্রময় বিচারকমণ্ডলী গঠন হইল একটি ‘এন্ড-ইন-ইটসেল্ফ’ কিংবা স্বয়ংসম্পূর্ণ একটি লক্ষ্য। বাহিরের কোনও উদ্দেশ্য বা বিধেয় দিয়া ইহাকে ব্যাখ্যা করিবার প্রয়োজন নাই। বিচারের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ যদি হয় বিচারকের দৃষ্টিভঙ্গি, তাহা হইলে বিচারকদের নির্বাচনে বৈচিত্র রক্ষা করিবার নীতিটির কোনও বিকল্প থাকিতে পারে না। এই প্রস্তাব দ্রুত কার্যকর হইলে দেশের সমগ্র সমাজ উপকৃত হইবে।