Jalpaiguri Mal River Disaster

‘দুর্ঘটনা’র পিছনে

এমন একটি বিপর্যয় নিয়েও ক্ষুদ্র রাজনীতির কারবারিরা যখন তৎপর হয়ে ওঠেন, নাগরিক সমাজের দায়িত্ব তখন আরও বহুগুণ বেড়ে যায়।

Advertisement
শেষ আপডেট: ০৮ অক্টোবর ২০২২ ০৫:৪৮
Share:

মালবাজারে নিরঞ্জনের সময় মাল নদীতে হড়পা বানে ভয়াবহ বিপর্যয়।

মালবাজারে বিজয়া দশমীর সন্ধ্যায় যা ঘটেছে তার পক্ষে ভয়াবহ, মর্মান্তিক, ইত্যাদি কোনও বিশেষণই যথেষ্ট নয়। উৎসবের সংশ্লেষ এই অঘটনে একটি বাড়তি মাত্রা যোগ করেছে— প্রতিমা বিসর্জনের সময় অগণন প্রাণ চলে যাওয়ার মধ্যে এমন একটি বীভৎসতা আছে, যার তুলনা মেলা কঠিন। যাঁরা প্রিয়জনকে হারালেন, কোনও ক্ষতিপূরণই তাঁদের ক্ষতি পূরণ করতে পারবে না। তাঁদের সমবেদনা জানানোর ভাষা আমাদের জানা নেই, তবুও যদি ওই সহনাগরিকদের সর্বনাশের মুহূর্তে সহমর্মিতার ঈষৎ অনুশীলন করতে পারি, প্রলম্বিত উৎসবের কলরোলের মধ্যে দাঁড়িয়েও তাঁদের সুতীব্র বেদনার কণামাত্র অনুভব করতে পারি, সেটুকুই হয়তো মানবিকতার ন্যূনতম দায় স্বীকার করার উপায়। এমন একটি বিপর্যয় নিয়েও ক্ষুদ্র রাজনীতির কারবারিরা যখন তৎপর হয়ে ওঠেন, নাগরিক সমাজের দায়িত্ব তখন আরও বহুগুণ বেড়ে যায়। সুস্থ, সভ্য মানবিকতার দায়িত্ব।

Advertisement

এই বিভীষিকার গহ্বর থেকেই উঠে আসে এক অমোঘ প্রশ্ন: এই ‘দুর্ঘটনা’ কি সত্যই অনিবার্য ছিল? প্রথমত, যে সময়ে যেখানে প্রতিমা নিরঞ্জনের আয়োজন, সেই স্থান-কালের বিচারে এমন দুর্ঘটনার জন্য অনেক বেশি প্রস্তুত থাকা উচিত ছিল না কি? ওই নদীতে ওই অঞ্চলেই আকস্মিক জলোচ্ছ্বাস অতীতেও ঘটেছে, এমনকি সাম্প্রতিক অতীতেও। বুধবার সন্ধ্যাতেও নাকি প্রশাসনের তরফে জলস্ফীতির পূর্বাভাস ঘোষণা করে সতর্ক করা হয়েছিল, সমবেত মানুষজন তাতে কান দেননি। সতর্কবাণীতে কান দেওয়ার অভ্যাস সমাজে প্রায় অন্তর্হিত হয়েছে, যে কোনও জনসমাগমে বহু মানুষের আচরণে এক ধরনের বেপরোয়া মানসিকতার পরিচয় মেলে, দুর্ঘটনার আশঙ্কা যার ফলে বহুগুণ বেড়ে যায়। কিন্তু জনতার দায়িত্বজ্ঞানের উপর ভরসা রেখে প্রশাসন বিপদের মোকাবিলা করতে চাইলে বুঝতে হবে, প্রকৃত অর্থে প্রশাসন এখনও জন্মায়নি। দুর্ঘটনা ঘটে যাওয়ার পরেও প্লাবিত মানুষের সন্ধানে ও তাঁদের উদ্ধার-কাজে বড় রকমের অপ্রস্তুতি ও বিলম্বের অভিযোগ উঠেছে। দুর্যোগ মোকাবিলার ক্ষেত্রে এ-রাজ্যে এমন ঘাটতি বারংবার প্রকট হয়ে ওঠে। তার প্রথম এবং প্রধান কারণ প্রয়োজনীয় তৎপরতার অভাব। শেষ-বর্ষার খরস্রোতা নদীতে প্রতিমা বিসর্জনের সময় ‘যে কোনও মুহূর্তে বিপর্যয় ঘটতে পারে’— এটা ধরে নিয়ে প্রস্তুত থাকতে হবে, এই প্রাথমিক শর্তই অপূর্ণ না থাকলে সম্ভবত বুধবারের প্রাণহানি কিছুটা কম হত।

দ্বিতীয় প্রশ্ন গভীরতর। নদীর এই ‘অস্বাভাবিক’ আচরণের পিছনে তার স্বাভাবিক গতি রোধের প্রবণতাটি কি বিপুল ভাবে দায়ী নয়? কেবল সেচ বা বিদ্যুৎ উৎপাদনের মতো প্রয়োজনেই নয়, যথেচ্ছ নগর-বিস্তারের চাপে এবং বেপরোয়া ব্যবসার তাড়নায় রাজ্য জুড়ে বহু নদীর উপর যে ভাবে অত্যাচার চলছে, তাদের সংশ্লিষ্ট বাস্তুতন্ত্রের সংস্থানকেই বদলে দেওয়া হচ্ছে, তার ফলে নদীর নিজস্ব গতি এবং পথ ক্রমাগত অবরুদ্ধ হয়ে পড়ছে। তার নানা ভয়ঙ্কর পরিণামের একটি হল আকস্মিক প্লাবন। পাহাড়ি এলাকায় জলধারায় আকস্মিক স্ফীতি নতুন নয়, কিন্তু তার এই বিধ্বংসী রূপটির পিছনে মানুষের যথেচ্ছাচারের এক বিরাট ভূমিকা সুস্পষ্ট। বস্তুত, মাল নদীর ওই অঞ্চলেই বিসর্জনের সুবিধার জন্য জলের ধারা রোধ করে লোকের চলাচলের ব্যবস্থা করা হয়ে থাকে। এই রীতিই সেখানে চলে আসছে। চলে আসছে বলেই এমন বিপজ্জনক রীতি চালিয়ে যেতে হবে? বিসর্জনের বিকল্প ব্যবস্থা খোঁজা হবে না? পাহাড় থেকে সদ্য নেমে আসা নদীর উপর এমন নিয়ন্ত্রণ যদি চলতে থাকে, কোনও না কোনও সময় তার প্রতিক্রিয়া কি অবধারিত নয়? নদীকে বিপর্যস্ত করলে সে বিপর্যয়ই ফিরিয়ে দেবে। যেমন ফিরিয়ে দিল বিজয়া দশমীর সন্ধ্যায়। নির্মম ভঙ্গিতে।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement