ফাইল চিত্র।
ছাত্র-নেতা আনিস খান কেন্দ্রীয় শাসকদের পাশাপাশি রাজ্যের শাসকদেরও বিরোধিতায় সক্রিয় এবং সরব ছিলেন, রাজ্যের শাসক দলের আঞ্চলিক মাতব্বরদের আক্রমণের আশঙ্কায় শঙ্কিত বোধ করিয়া তিনি পুলিশকে চিঠিও লিখিয়াছিলেন। পুলিশের বক্তব্য: চিঠিটি তাহাদের কাছে আসিবার পরে ‘আইনি প্রক্রিয়া’ শুরু হইয়াছে। এমন মহতী তৎপরতার জন্য পুলিশকে পুরস্কৃত করিবেন কি না, পুলিশমন্ত্রী ভাবিতে পারেন। শুক্রবার রাত্রির অন্ধকারে আনিস খানের বাড়িতে চড়াও হইয়া তাঁহাকে সরাইয়া দিবার বেআইনি প্রক্রিয়াটি অবশ্য ইতিমধ্যে সম্পন্ন। হানাদারদের পরনে পুলিশের পোশাক ছিল, কিন্তু তাহারা সত্যই পুলিশ, না কি তৃণমূল কংগ্রেসের আঞ্চলিক গুন্ডা, অথবা অন্য কোনও বাহিনী, সেই সকল প্রশ্নের উত্তর তদন্তসাপেক্ষ। সদুত্তর মিলিবে কি? এই ভয়াবহ হত্যাকাণ্ডের যথাযথ তদন্ত হইবে, না তদন্তের নামে সমগ্র ঘটনাটিকে ধামাচাপা দিবার অথবা সাক্ষ্যপ্রমাণ লোপাট করিয়া ক্ষমতাবানদের পক্ষে সুবিধাজনক সিদ্ধান্তে পৌঁছাইবার বন্দোবস্ত হইবে? ঘটনার পরে প্রথম দুই দিন প্রাথমিক অনুসন্ধানের যে গতি ও প্রকৃতি দেখা গিয়াছে, তাহাতে এমন সংশয় অস্বাভাবিক নহে। ‘সিট’ গঠনের সাড়ম্বর ঘোষণায় সেই সংশয় এক বিন্দুও কমে না।
শাসক দলের সর্বাধিনায়িকা তথা রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ঘটনার পরে প্রথম দুই দিন নীরব ছিলেন। শেষ অবধি নীরবতা ভাঙিয়াছেন, বিধিবদ্ধ আশ্বাস উচ্চারণের সহিত তিনি বাড়তি ‘তথ্য’ পরিবেশন করিয়াছেন— আনিস খান তাঁহাদের সহিত যোগাযোগ রাখিতেন, নির্বাচনে তাঁহাদের সাহায্য করিয়াছিলেন। তাঁহাদের, অর্থাৎ তৃণমূল কংগ্রেসের। সরকার এবং দল একাকার করিয়া দিবার এমন দৃষ্টান্তে পশ্চিমবঙ্গের নাগরিক সম্পূর্ণ অভ্যস্ত। সেই প্রসঙ্গ থাকুক। মুলতুবি থাকুক তাঁহার পরিবেশিত ‘সংবাদ’-এর সত্যাসত্য বিনিশ্চয়ের প্রশ্নও। কিন্তু এই খবরটি জানাইয়া দলনেত্রী কী বুঝাইতে চাহিতেছেন? শাসকের সহিত যোগাযোগ না রাখিলে, শাসক দলের বিরোধিতা করিলে এমন পরিণতির সম্ভাবনা বাড়ে? আনিস খান ‘ভাল ছেলে’ কি না তাহা সম্পূর্ণ অবান্তর, তাঁহার জীবনের যে পরিণতি হইয়াছে তাহা শাসকদের পক্ষে চরম লজ্জা ও কলঙ্কের কারণ।
মুখ্যমন্ত্রী সম্ভবত তাহা জানেন। বামফ্রন্ট আমলে বিবিধ উপলক্ষে বিরোধী হিসাবে তিনি সরকারের নৈতিক দায়ের কথাই সর্বদা তারস্বরে ঘোষণা করিতেন। এখন তিনি শাসক, সরকারি ক্ষমতার সমস্ত পরিসরে তাঁহার দল আপনাকে প্রতিষ্ঠিত করিয়াছে, অতএব রাজধর্ম পালনের দায়ও ফুরাইয়াছে? কিন্তু প্রশ্ন কেবল ‘নৈতিক’ দায়ের নহে। প্রশ্ন দুঃশাসনের প্রত্যক্ষ দায়িত্ব স্বীকার করিবার, রাজ্য জুড়িয়া বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন স্তরে যে মূর্তিমান দুঃশাসনেরা উত্তরোত্তর ক্ষমতার দাপটে নাগরিকদের জীবন অতিষ্ঠ করিয়া বেড়াইতেছে এবং প্রতিবাদ বা বিরোধিতাকে চণ্ডশক্তিতে দমন করিতে ঝাঁপাইয়া পড়িতেছে তাহাদের কঠোর শাস্তি দিয়া সুশাসন ফিরাইবার। অথচ ঘটিতেছে তাহার বিপরীত। শাসকের বিরুদ্ধে কিছু বলা চলিবে না, প্রতিবাদ করিলেই কোথাও সরকারি আক্রমণ নামিয়া আসিবে, কোথাও দলীয় বাহিনী চড়াও হইবে এবং পুলিশ দাঁড়াইয়া দেখিবে— ইহাকে জঙ্গলের রাজত্ব বলিলে জঙ্গলের অপমান করা হয়। আনিস খানের হত্যাকাণ্ড পশ্চিমবঙ্গের প্রতাপ-অন্ধ দলতন্ত্রের ভয়াবহ রূপটিকেই আরও এক বার চোখে আঙুল দিয়া দেখাইয়া দিল। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করিয়া সংগঠিত প্রতিবাদ সম্পর্কে কলিকাতার মেয়র তথা রাজ্যের মন্ত্রী তথা অধুনা-উদ্ভাসিত সরকারি মুখপাত্র প্রশ্ন তুলিয়াছেন: বিক্ষোভ করিয়া আর লাভ কী? প্রশ্নটি নির্বোধ; তবে বিক্ষোভ না করিলে যে শাসকের লাভ, তাহা অতি বড় নির্বোধেও বুঝিতে পারে।