ফাইল চিত্র।
চাকুরিতে বদলি অপেক্ষা মৃত্যুও ভাল, এমন চিন্তা কী করিয়া প্রবল হইল? বদলির আদেশ পাইয়া শিশু শিক্ষা কেন্দ্রের শিক্ষকদের বিষপান, ও মেডিক্যাল কলেজের এক শিক্ষক-চিকিৎসকের আত্মহননের সংবাদ রাজ্যকে আন্দোলিত করিয়াছে। প্রশ্ন উঠিয়াছে, এই শিক্ষকেরা কী করিয়া কর্মক্ষেত্রে এতই নাচার হইয়া পড়িলেন যে, আপন জীবননাশ করিয়া মুক্তি খুঁজিবার চেষ্টা করিলেন? তাঁহাদের বদলির প্রক্রিয়ার মধ্যে কি তবে কোনও অন্যায্যতা রহিয়াছে? এই রাজ্যে ‘বদলিনীতি’ লইয়া অভিযোগ কম উঠে নাই। কাগজে-কলমে বদলির নীতি যাহাই থাক, বিভিন্ন সরকারি দফতরে বস্তুত স্বজনপোষণ এবং দুর্নীতির দ্বারাই বদলি নির্ধারিত হয়, এই ধারণা ক্রমশ শক্তি সঞ্চয় করিতেছে। সাম্প্রতিক ঘটনাগুলির পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন শ্রম সংগঠন মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নিকট একটি চিঠি পাঠাইয়া বদলিতে স্বচ্ছতা দাবি করিয়াছে। বিষয়টি যথেষ্ট গুরুত্ব দাবি করে। আনুগত্যের পুরস্কার, বিরোধিতার শাস্তি, অথবা সরাসরি উৎকোচ প্রদান দ্বারা বদলি নির্ধারিত হইতেছে, এমন অভিযোগ বার বার সংবাদে আসিয়াছে।
ফলে যাঁহাদের ‘বিশেষ পথ’-এর সুযোগ লইবার মতো পরিচিতি বা প্রভাব নাই, তাঁহারা সর্বাধিক বিপন্ন বোধ করিতেছেন। শিক্ষক-চিকিৎসক অবন্তিকা ভট্টাচার্য সম্ভবত আপন পছন্দের জায়গায় কাজ করিবার আশা হারাইয়াছিলেন। স্বচ্ছ এবং ন্যায্য বদলি নীতি থাকিলে এই পরিণতি হইত না। মানবসম্পদের এই অপচয় কি অপরিহার্য ছিল? এ কথা সত্য যে, বৃহৎ কর্মক্ষেত্রে যে ব্যবস্থা বহু ব্যক্তির জীবন নির্ধারণ করে, তাহা সকল কর্মীর ব্যক্তিগত সুবিধা ও চাহিদার প্রতি সর্বদা সংবেদনশীল হইতে পারে না। তাহার ফলে কর্মীদের পারিবারিক ও ব্যক্তিগত জীবনে যে সঙ্কট উপস্থিত হইতে পারে, তাহা সত্য। আপন জীবনসঙ্গী, সন্তান, চেনা পরিসর হইতে বিচ্ছিন্ন হইয়া বহু দূরে বাস করিবার মনোবেদনা যেমন রহিয়াছে, তেমনই রহিয়াছে আর্থ-সামাজিক নানা সঙ্কটও। ভিন্ন জেলা অথবা রাজ্যে কাজ করিতে গেলে নানা প্রকার অনিশ্চয়তা এবং বিরোধিতার মুখোমুখি হইতে হয়। এই অসুবিধা সত্ত্বেও চাকুরিতে বদলি সহনীয় বলিয়া বোধ হইত, যদি তাহাতে একটি ন্যায্যতার বোধ থাকিত। ব্যক্তিগত সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য, পছন্দ-অপছন্দ নির্বিশেষে প্রত্যেক কর্মীকেই কার্যবিধি মানিতে হয় বলিয়াই তাহা ন্যায্য বলিয়া গৃহীত হয়। অর্থাৎ, ব্যবস্থার অন্তর্গত সুবিধা এবং অসুবিধা, দুটোই সকল কর্মীর মধ্যে নির্দিষ্ট নিয়ম অনুসারে সমবণ্টিত হইবে— এই প্রত্যয়ই কর্মীদের চালিত করে।
প্রভাবশালীরা সেই বিশ্বাসে আঘাত দিয়া গোটা ব্যবস্থাকেই দূষিত করিতেছেন। বদলির ভয় দেখাইয়া আনুগত্য আদায়ের চেষ্টা এই রাজ্যে নূতন নহে। স্কুলশিক্ষা কিংবা মেডিক্যাল শিক্ষার ক্ষেত্রে শিক্ষকবণ্টনের নকশা দেখিলে এমনও সংশয় জাগিবে যে, শিক্ষকের বদলিতে ছাত্র অথবা রোগীর স্বার্থই বা কতটুকু রক্ষিত হইয়াছে? কেবল কর্মী পাঠাইলেই হয় না, তাঁহাকে কাজের সহায়ক ব্যবস্থাও দিতে হইবে। যেমন, স্বাস্থ্যকেন্দ্রগুলিতে ন্যূনতম পরিকাঠামোর অভাব, তাহা জানিয়াও কোনও চিকিৎসক উৎসাহী হইবেন বদলি হইতে, তাহার আশা কম। সরকারি কর্মীদের একটি বড় অংশ বদলিকে তাই আপন ব্যর্থতা এবং অক্ষমতা বলিয়া গণ্য করিতেছেন। এই ব্যর্থতা প্রশাসনের।