ডাক্তার সবার চিকিৎসা করেন, কিন্তু ডাক্তারের চিকিৎসা করে কে— এই প্রচলকথায় এক গভীর সত্য নিহিত আছে। ডাক্তার এখানে নিতান্ত প্রতীকী— সেই সব কাজের যা স্রেফ পেশা বা জীবিকার ঊর্ধ্বে আরও বেশি কিছু: দায়িত্ববোধ, হিতাহিতজ্ঞান, যুক্তিশীল আচরণ যার অঙ্গাঙ্গি। এই সব কিছুর পরাকাষ্ঠা বলে মানা হয় বিচারপতিকে: ভারতীয় সংবিধান যাঁকে সাংবিধানিক মূল্যবোধ রক্ষার দায়িত্ব পরম নিশ্চিন্তিতে সঁপে দিয়েছে; কাজে যোগদানের প্রথম মুহূর্ত থেকে যিনি সমদর্শন ও নিরপেক্ষতার লালন ও পালনে অঙ্গীকারবদ্ধ, কর্মজীবনের শেষ ক্ষণটি পর্যন্ত এই ধারণাগুলির প্রতিমূর্তি। কিন্তু অনেক সময় বিচারপতিদের প্রকাশ্য আচরণেই এর বিপরীত চিত্রটি ফুটে উঠতে দেখা যায়। ইলাহাবাদ হাই কোর্টের সাম্প্রতিক ঘটনা সেই উদ্বেগ আবার তৈরি করছে। ডিসেম্বরে বিশ্ব হিন্দু পরিষদের আইনি সেল আয়োজিত এক আলোচনায় বিচারপতির মন্তব্যগুলি অত্যন্ত বিভেদাত্মক, সন্দেহ নেই। অভিন্ন দেওয়ানি বিধি প্রসঙ্গে বলতে গিয়ে সংখ্যালঘু আইনকে হেয় করার জন্য সংখ্যালঘুদের সম্পর্কে আপত্তিকর শব্দ ব্যবহারের কোনও দরকার ছিল না। কিন্তু মাননীয় বিচারপতির বয়ানে এমন কথাই শোনা গেল, ‘এ দেশটা হিন্দুস্থান, সংখ্যাগরিষ্ঠের ইচ্ছা অনুযায়ীই দেশ চলবে, সেটাই আইন।’
বাস্তবিক, এই ভাষা ও ভঙ্গিকে ব্যতিক্রমী বলা চলে না। আজকের ভারতে খুব চেনা ভাষাই বিচারবিভাগের বয়ানে উঠে এল। দেশের ছোট-বড় নেতা এবং হিন্দুত্ববাদী প্রতিষ্ঠানগুলি এই লব্জেই কথা বলে। তাদের সমর্থকরাও এই ঘৃণা ও বিদ্বেষেরই চাষ করে। কিন্তু নাগরিকের মুখে আর বিচারকের মুখে একই কথা মানায় কি? অবশ্য এমন ঘটনা নতুন নয়। বিতর্কিত আচরণ বা পদক্ষেপ এই হাই কোর্টে আগেও দেখা গিয়েছে। রাম বা কৃষ্ণকে সম্মান দেখানো বাধ্যতামূলক করতে আইন আনার কথা শোনা গিয়েছে। গোরক্ষাকে সংবিধানে বলা মৌলিক অধিকারের অঙ্গ করার প্রস্তাব ধ্বনিত হয়েছে। এই সবই নিশ্চিত ভাবে বুঝিয়ে দেয়, কোনও বিশেষ রাজনৈতিক ভাবধারা অনুসারেই বিচার সংঘটিত হচ্ছে। প্রশ্ন হল, ব্যক্তিগত ভাবে কোনও বিশেষ রাজনৈতিক মতাদর্শের প্রতি অনুরক্তি যে কোনও নাগরিকের থাকতেই পারে— কিন্তু সেই নাগরিক যখন বিচারপতি, তাঁর পক্ষে এই আচরণ বা এই কথা সাজে কি? এ তো কেবল শোভনতা বা সুবিবেচনার বিষয় নয়, এমন আচরণ তো নিশ্চিত ভাবেই সাংবিধানিক মূল্যবোধের লঙ্ঘন; যে নিরপেক্ষতা রক্ষার শপথ নিয়ে বিচারকার্য চলছে, সেই আদর্শেরও ভূলুণ্ঠন।
আজকের ভারতকে অবশ্য এমন ঘটনার পর, দুঃখপ্রকাশ দূরস্থান, আত্মপক্ষ সমর্থনও দেখতে হয়। গত মাসেই সুপ্রিম কোর্টের কলেজিয়ামের তলবে উপস্থিত হয়ে মাননীয় বিচারপতি যুক্তি দেখিয়েছেন যে তিনি ওই কথাগুলি বলেছেন সামাজিক সমস্যার পরিপ্রেক্ষিতে, এতে সংবিধানের নীতি বা বিচারপতির মর্যাদা লঙ্ঘিত হয়নি, তাই ক্ষমাপ্রার্থনার প্রশ্ন নেই। শীর্ষ আদালত অবশ্য এত সত্ত্বেও তাঁকে সতর্ক করেছে, কী ভাবে কথা বলতে হবে, সাংবিধানিক পদমর্যাদা কী ভাবে অটুট রাখতে হবে, তা নিয়ে। এমন প্রগল্ভতা কখনওই এক জন বিচারপতির আচরণীয় হতে পারে না, বিশেষত রাজনৈতিক ও আইনি স্পর্শকাতর বিষয়ে তো কখনওই নয়। দেশের নাগরিক ধর্মবর্ণশ্রেণিলিঙ্গ নির্বিশেষে বিচারব্যবস্থার মুখাপেক্ষী। তার বিশ্বাসযোগ্যতা প্রতি মুহূর্তে নিশ্চিত করা বিচারপতিদের কাজ। এ সব গোড়ার কথা যে মনে করিয়ে দিতে হচ্ছে, তা-ই প্রমাণ করে— ডাক্তারেরও মাঝেমধ্যে চিকিৎসার প্রয়োজন হয়। ১৯৯৭ সালে বিচারবিভাগের মূল্যবোধ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে সুপ্রিম কোর্ট বিচারপতিদের একটি ‘গাইডলাইন’ তৈরির চেষ্টা করেছিল। হয়তো আবারও তেমন পদক্ষেপ করার কথা ভাবার সময় এসেছে।