—প্রতীকী চিত্র।
গতকাল পরীক্ষা শেষ হয়েছে, ফলাফল জানতে আরও দু’দিনের প্রতীক্ষাপর্ব। দেড় মাস ব্যাপী নির্বাচনী অভিযানের শেষে আপাতত ভারতবর্ষীয় ভোটদাতাদের হাতে রয়েছে শ্রীমদ্ভগবদ্গীতার দ্বিতীয় অধ্যায়ের সাতচল্লিশ নম্বর শ্লোক। তার প্রথমার্ধটি বহুচর্চিত: ‘কর্মেই তোমার অধিকার, কর্মের ফলে কখনও নয়’। কিন্তু ওই শ্লোকের দ্বিতীয় অর্ধটিও অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক, কারণ তৃতীয় পাণ্ডবকে তাঁর সারথি সেখানে উপদেশ দিয়েছেন: ‘কর্মের ফল কামনা করবে না, অকর্মাও হবে না।’ প্রাসঙ্গিক একাধিক অর্থে। একটি অর্থ নিতান্ত সহজ ও সরল: ভোটের ফল পছন্দসই হোক বা না হোক, ভোট দিতে হয়, অকর্মা হয়ে থাকা চলে না— এই উপদেশ স্মরণ করলে ভোটদাতা উদ্বেগময় অস্থির চিত্তকে শান্ত রাখতে পারবেন, পরাজিতের দলে স্থান হলেও নিষ্কাম ধর্ম পালনের গৌরব বোধ করতে পারবেন। কিন্তু মহাভারতের সর্বাপেক্ষা কূটবুদ্ধিসম্পন্ন পুরুষের উচ্চারিত কথাটির এক গূঢ়তর অর্থও আজ কল্পনা করা যায়। সেই অর্থটি গণতন্ত্রের মর্মস্থল থেকে উঠে এসে এক জটিল বিবর্তনের স্বরূপ উন্মোচিত করে: গণতন্ত্র যা ছিলেন সেখান থেকে গণতন্ত্র যা হইয়াছেন, সেই গুরুত্বপূর্ণ ও গুরুতর বিবর্তন।
গণতন্ত্র বিষয়ক যে কোনও আলোচনার শুরুতেই ফাঁদ পেতে রাখে একটি প্রশ্ন: গণতন্ত্র মানে কী? দুনিয়া জুড়ে বহু দিন ধরে এই বিষয়ে অনন্ত সওয়াল-জবাবের যে সম্ভার পুঞ্জীভূত হয়ে চলেছে, তার কাছে মহাভারতও যৎসামান্য। অতএব সেই ফাঁদটিকে সযত্নে এড়িয়ে চলাই সুবিবেচনার কাজ। তার সহজ উপায় হল, যে নির্বাচনী গণতন্ত্রের মহোৎসব সদ্য সমাপ্ত হয়েছে, সেই ব্যবস্থাটিকে নিয়েই চিন্তা করা। তার একটি সহজ যুক্তিও আছে: উইনস্টন চার্চিলের প্রসিদ্ধ উক্তিটিকে ঈষৎ পাল্টে নিয়ে বলা যায়, নির্বাচনী গণতন্ত্র হল নিকৃষ্টতম ব্যবস্থা, তবে অন্য সব ধরনের গণতন্ত্রকে বাদ দিলে! দেশের সমস্ত প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিক বহু দল বা গোষ্ঠীর প্রার্থীদের মধ্যে থেকে অবাধ নির্বাচনের মাধ্যমে যে প্রতিনিধিকুলকে বেছে নেবেন, তাঁরাই শাসনতন্ত্র চালনা করবেন— এই বন্দোবস্তটির প্রথম এবং প্রধান জোর তার বাস্তববাদী চরিত্রে। দুনিয়ার বহু দেশের ইতিহাস বারংবার প্রমাণ করেছে, এই ব্যবস্থাটির মধ্য দিয়ে শাসকের অপরাধের জন্য তাকে প্রত্যাখ্যান করে শাস্তি দেওয়া যায়, দুঃশাসনের অবসান ঘটানো যায়, শাসনধারায় সংশোধন আনা যায়। স্বাধীন ভারতের ইতিহাসেও তেমন ঘটনা সর্বজনবিদিত। এই পরিবর্তনের সম্ভাবনাই গণতন্ত্রের অনন্য শক্তি। এই কারণেই গণতান্ত্রিক রাজনীতি সম্ভাবনার শিল্প।
সমকালীন ভারতে রাজনীতিকরা সেই সম্ভাবনাকে যেখানে নিয়ে গিয়েছেন এবং নির্বাচনী ব্যবস্থাটিকে যে রূপ দিয়েছেন, তাকেও এক অর্থে শিল্পকর্মই বলতে হয়, তবে তা বহুলাংশেই এক উৎকট প্রতিমা, যা একই সঙ্গে বিবমিষা এবং বিভীষিকা উৎপাদন করে চলে। গত কয়েক মাস ধরে প্রতিনিয়ত সেই মূর্তি দর্শন করে নাগরিকরা আতঙ্কিত। এই পরিস্থিতিতেই প্রশ্ন ওঠে: রাজনীতিকদের এক বড় অংশের দুরাচারের কবল থেকে নির্বাচনী গণতন্ত্রকে উদ্ধার করার উপায় কী? সুকঠিন এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হবে গীতার ওই বাক্যাংশটিতে: অকর্মা হবে না। ভোটের দিনে ভোট দিয়ে এলেই নাগরিকের কর্মযোগ সম্পন্ন হয় না। গণতন্ত্র তখনই সার্থকনামা হতে পারে, যদি তাঁরা প্রত্যেকে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার স্বাস্থ্যরক্ষায় যত্নবান হন। ক্ষমতাবানেরা সেই ব্যবস্থাকে নিজেদের কব্জায় এনে যথেচ্ছাচারে তৎপর হলে নাগরিকের দায়িত্ব বহুগুণ বেড়ে যায়। এখানেই নাগরিক প্রজা থেকে স্বতন্ত্র। প্রজার নিজের কিছু করার নেই, রাজার অনুগমনই তার ধর্ম। নাগরিকের কর্তব্য ক্ষমতাবানের উপর নিরন্তর সামাজিক নজরদারির মধ্য দিয়ে আপন অধিকার কড়ায় গণ্ডায় বুঝে নেওয়ার তৎপরতা। প্রজা অকর্মক, নাগরিক সকর্মক। এই পরিপ্রেক্ষিতে বিশেষ দায়িত্ব এসে পড়ে সমাজের শিক্ষিত, সচেতন বর্গগুলির উপর, যাঁদের সুযোগ আছে, সামর্থ্য আছে, কণ্ঠস্বর আছে। দুঃখের কথা, সমকালীন ভারতে তাঁদের একটি বড় অংশ সেই দায়িত্ব শিকেয় তুলে শাসকের খিদমত খাটেন অথবা দুঃশাসনের প্রতি চোখ বুজে থাকেন। আশার কথা, ব্যতিক্রমী একটি অংশ শাসকের অন্যায় আধিপত্যের বিরুদ্ধে প্রতিস্পর্ধী অবস্থানে আপসহীন। তাঁরাই গণতন্ত্রের ভরসা, তার অমিত সম্ভাবনার ধারক ও বাহক। মহাভারতের প্রাজ্ঞ উপদেষ্টাকে সামনে পেলে তাঁরা স্পষ্ট স্বরে জানাবেন: কেবল কর্মে নয়, তার ফলেও আমার পূর্ণ অধিকার। গণতান্ত্রিক অধিকার।