ফাইল চিত্র।
অমিত শাহ হিন্দি দিবস উপলক্ষে প্রদত্ত ভাষণে বলিয়াছেন, হিন্দি কোনও আঞ্চলিক ভাষার প্রতিদ্বন্দ্বী নহে, বন্ধু তথা মিত্র; আঞ্চলিক ভাষাগুলির সহিত সহাবস্থানের মধ্য দিয়াই হিন্দি ভাষার প্রসার ঘটিতে পারে। অতঃপর হিন্দি ভাষা হয়তো মন্ত্রিবরের নির্দেশনায় বিবিধ আঞ্চলিক ভাষাকে ডাকিয়া ‘আয় তবে সহচরী’ বলিয়া নৃত্যগীতের উপক্রম করিবে। মাত্র দুই বৎসর পূর্বে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বলিয়াছিলেন, একমাত্র হিন্দি ভাষার মাধ্যমেই দেশের ঐক্য সাধন সম্ভব। ইহা কোনও বিচ্ছিন্ন বা বিক্ষিপ্ত বক্তব্য ছিল না, তিনি এবং তাঁহার দল তথা সঙ্ঘ বরাবর ভারতে হিন্দির আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় তৎপর; ‘এক দেশ এক ভাষা’ স্লোগান তাঁহাদের বীজমন্ত্র; বিভিন্ন উপলক্ষে, কেবল দলীয় অনুষ্ঠানে নহে, সরকারি কাজেও হিন্দি চাপাইয়া দিতে এই শাসকদের তৎপরতার অন্ত নাই। আজ সহসা পরাক্রমী নায়কের মুখে এই ‘বিবিধের মাঝে দেখো মিলন মহান’— চমৎকৃত করে বইকি।
দুর্জনে বলিতেই পারে, হিন্দি বলয়ের বাহিরে ভোটের বাজারে আশানুরূপ সওদা করিতে ব্যর্থ হইয়াই বিজেপির নেতা ও নির্বাচনী সেনাপতি এখন সহাবস্থানের শান্তিজল ছিটাইতে নামিয়াছেন। দক্ষিণ ভারতে তো বটেই, এমনকি পশ্চিমবঙ্গেও তাঁহাদের অতিরিক্ত দাপট দেখাইবার ভাষা ও ভঙ্গি রাজ্যের বহু নাগরিকের মনে বিরাগ, এমনকি বিতৃষ্ণা উৎপাদন করিয়াছে, এই সত্য না বুঝিবার মতো নির্বোধ তাঁহারা নহেন। ইহা বিলক্ষণ সম্ভব যে, আঞ্চলিক ভাষার প্রতি এই নূতন অনুরাগ নিতান্তই একটি রাজনৈতিক কৌশল। কিন্তু রাজনীতির কারবারিরা যাহা করিবার, রাজনৈতিক তাড়নাতেই করিবেন, সুতরাং চাপে পড়িয়াও যদি পরুষ আধিপত্যবাদের হম্বিতম্বি কিঞ্চিৎ প্রশমিত হয়, তাহা গণতন্ত্রেরই মহিমা। তবে লক্ষণীয়, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিন্দির মহিমা কীর্তনে বিরত হন নাই, এবং সেই কীর্তন যথারীতি মোদী-বন্দনায় পর্যবসিত হইয়াছে। অমিত শাহের মতে, প্রধানমন্ত্রী কেবল সমস্ত আন্তর্জাতিক মঞ্চে হিন্দিতে ভাষণ দিয়া জগৎসভায় ভারতের মহিমা বৃদ্ধি করেন নাই, কোভিড বিষয়ে জাতির উদ্দেশে ভাষণগুলি তিনি হিন্দিতে দিবার ফলেই নাকি অতিমারির মোকাবিলায় ভারত আরও বেশি সফল হইয়াছে। সরকার ও শাসক দলের বলয় হইতে গোময়-গোমূত্রাদি কোভিড প্রতিরোধের সাড়ে বত্রিশ প্রকারের দাওয়াইয়ের কথা শোনা গিয়াছে বটে, তবে নরেন্দ্র মোদী যে ভাষার জোরে ‘মুখেন মারিতং কোভিড’ করিয়াছেন, তাহা জানা ছিল না।
নীরবতাও ভাষা অপেক্ষা কম শক্তিমান নহে। অমিত শাহ যাহা বলেন নাই, তাহাও তাৎপর্যপূর্ণ। তিনি ‘সরকারি ভাষা’ হিসাবে হিন্দির কথা বলিয়াছেন, আঞ্চলিক ভাষার কথা বলিয়াছেন, কিন্তু আর একটি সরকারি ভাষার কথা বলেন নাই, তাহার নাম ইংরেজি। ইংরেজি কেবল সংবিধানে স্বীকৃত নহে, ভারতীয় সমাজ, অর্থনীতি এবং রাজনীতির ভাষা হিসাবে, সর্বভারতীয় সংযোগের ভাষা হিসাবে এবং ভারতের সহিত বিশ্বের যোগসূত্র হিসাবে তাহার গুরুত্ব অপরিসীম। হিন্দি বলয়ের বাহিরে ভারতের বিস্তীর্ণ অংশে সংযোগের মাধ্যম হিসাবেও এই ভাষাটি কার্যত অপরিহার্য, এমনকি হিন্দিভাষী রাজ্যগুলিতেও বাস্তবের প্রয়োজনে ইংরেজি শিক্ষার তাগিদ প্রবল। তদুপরি, হিন্দির মাধ্যমে আঞ্চলিক আধিপত্য বিস্তারের যে ইতিহাস, ইংরেজির ক্ষেত্রে সেই সমস্যা নাই, স্বাধীনতার সাত দশক পার হইবার পরে এবং পৃথিবী বদলাইবার ফলে তাহার ঔপনিবেশিক ‘দোষ’ও কাটিয়া গিয়াছে। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীরা বোধ করি তাহা মানিতে নারাজ। তাঁহারা যে ভারত গড়িতে চাহেন, সেখানে ইংরেজি ‘বহিরাগত’। এই কূপমণ্ডূক মানসিকতা আঞ্চলিক ভাষাগুলির পক্ষেও শুভ নহে। শুভ নহে হিন্দির পক্ষেও। ভুলিলে চলিবে না, হিন্দিও আঞ্চলিক ভাষাই।