প্রতীকী চিত্র।
পুনর্মূষিকো ভব। স্কুল সার্ভিস কমিশনের (এসএসসি) ঘোষিত তালিকায় তুষ্ট হইয়াছিল কলিকাতা হাই কোর্ট, উচ্চ প্রাথমিক স্তরে শিক্ষক নিয়োগের উপর স্থগিতাদেশ প্রত্যাহৃত হইয়াছিল, এই বার ডিভিশন বেঞ্চে মামলা করিলেন একাধিক চাকুরিপ্রার্থী। অভিযোগ, যথারীতি প্রক্রিয়াগত অস্বচ্ছতার। তথ্য বলিবে, পরীক্ষা লইবার পর পাঁচ বৎসর অতিক্রান্ত হইয়াছে, যোগ্য প্রার্থী তালিকাও একাধিক বার প্রকাশিত হইয়াছে, কিন্তু কিছু না কিছু বেনিয়মের অভিযোগে প্রক্রিয়া স্থগিত থাকিয়াছে, বারংবার আদালতের শরণ লইয়াছে সব পক্ষই। বস্তুত, পশ্চিমবঙ্গে সরকারি শিক্ষক নিয়োগের প্রক্রিয়াটিকে কেন্দ্র করিয়া যে বিপুল অবিশ্বাস জন্ম লইয়াছে, যাহা দীর্ঘকালীন মামলা-মকদ্দমার পাকেচক্রে প্রতিভাসিত, তাহা আর কেবল প্রশাসনিক ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ নাই। তাহাতে রাজনীতির মারপ্যাঁচও ঢুকিয়া পড়িয়াছে। চাকরি দিবার টোপটি ঝুলাইয়া রাখিলে রাজনীতির কারবারিদের লাভ আছে। তাহাতে সরকার পক্ষের ঘাটতি ঢাকা পড়ে, বিরোধী পক্ষও ‘কর্মসংস্থানের অভাব’ লইয়া শোরগোল তুলিতে পারে।
রাজনীতির দশচক্রে যে প্রশ্নটি বেবাক হারাইতে বসিয়াছে, তাহা কর্মসংস্থান নহে— শিক্ষা। আক্ষেপের বিষয়, নিয়োগ প্রক্রিয়ার অস্বচ্ছতা সম্পূর্ণত এক চাকুরিকেন্দ্রিক বিতর্কে পর্যবসিত হইয়াছে। রাজ্যবাসী ভুলিতে বসিয়াছে, শিক্ষক নিয়োগ না হইবার অর্থ অসংখ্য ছাত্রছাত্রীর পড়াশোনার মানের সহিত আপস করা, ক্ষেত্রবিশেষে তাহা স্থগিত হইয়া যাওয়া। এক্ষণে বহু স্কুলেই পর্যাপ্ত স্থায়ী শিক্ষক নাই, এমনকি কিছু কিছু বিষয় শুধুই পার্শ্বশিক্ষক বাহিনীর উপর নির্ভরশীল। এই শোচনীয় ঘাটতি সমীক্ষাতেও প্রকাশিত— উচ্চ প্রাথমিক স্তরে সারা ভারতে ছাত্র-শিক্ষক অনুপাত ১৮:১, পশ্চিমবঙ্গে তাহা ২৭:১। কিন্তু প্রশাসন হউক বা সমাজ, সকলেই চাকুরিপ্রার্থীদের বঞ্চনার আবর্তে ঘুরপাক খাইতেছে। প্রশ্ন উঠিতেছে না— যথাযথ শিক্ষক নিয়োগ না হইবার ফলে কাহার স্বার্থ সর্বাধিক ক্ষুণ্ণ হইতেছে? কোন প্রজন্মের উপর চিরকালের জন্য দাগ পড়িয়া যাইতেছে? কর্মসংস্থানের সঙ্কট সমাধান করা অবশ্যকর্তব্য। কিন্তু শিক্ষাক্ষেত্রে শিক্ষার্থীর স্বার্থই অগ্রাধিকার পাওয়া বিধেয়। প্রক্রিয়াটিকে তাই ছাত্রছাত্রীদের ভবিষ্যতের নিরিখে বিচার করিতে হইবে। না হইলে বিপদের প্রধান স্বরূপটি অদৃষ্ট রহিয়া যাইবে।
ইহা স্পষ্ট যে, তালিকা প্রকাশ এবং পুনঃপুনঃ মামলা-মকদ্দমার দুষ্টচক্র হইতে নিষ্কৃতি পাইবার পথটি সহজ নহে। সঙ্কটের মূলে আছে এক চরম সন্দেহ, বিশ্বাসযোগ্যতা তৈরি করা তাই অতি জরুরি। এই রূপ বিশ্বাস— পরীক্ষা গ্রহণ হইতে তালিকা প্রকাশ পর্যন্ত প্রক্রিয়ায় কোনও অস্বচ্ছতা থাকিবে না, এবং কোনও স্তরে কখনও পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ উঠিবার সুযোগই মিলিবে না। জমানা পাল্টাইলেও শিক্ষাক্ষেত্রে সরকারের নিরপেক্ষতার অভাব সম্পর্কিত অভিযোগটির সুরাহা হয় নাই। চাকুরির পরীক্ষা পরিচালনার সম্পূর্ণ দায়িত্ব কোনও বেসরকারি সংস্থার হাতে তুলিয়া দেওয়া যায় কি না, যাহাতে প্রক্রিয়াটিতে পক্ষপাত বা দুর্নীতির অবকাশই না থাকে, তাহা ভাবিয়া দেখা যায়। সরকারি ব্যবস্থা ক্ষুদ্র রাজনৈতিক আগ্রহে আচ্ছন্ন। দুর্নীতির বিষদন্ত ভাঙিতে, অতএব, বেসরকারি সাহায্যের কথা ভাবিয়া দেখা যায়।