কোভিড-১৯’এর দ্বিতীয় তরঙ্গে ভারতে মৃত্যুমিছিল অব্যাহত। হাসপাতালের শয্যা, অক্সিজেন, ঔষধ, টিকার অভাবে এখনও ধুঁকিতেছে একাধিক রাজ্য। কিন্তু গুজরাতের তেতোড়া গ্রামের একটি কোভিড-কেন্দ্রকে সেই হাহাকার স্পর্শ করে নাই। কারণ, গোশালায় গড়িয়া তোলা কেন্দ্রটিতে কোভিড-আক্রান্ত রোগীদের চিকিৎসা হইতেছে সম্পূর্ণ ‘দেশীয়’ পদ্ধতিতে, গোমূত্র প্রয়োগে। শুধুমাত্র গুজরাতই নহে, উত্তরপ্রদেশের এক বিজেপি নেতাও সম্প্রতি জোর সওয়াল করিয়াছেন গোমূত্র পানের সপক্ষে। ‘ভক্ত’রাও কেহ গোমূত্রের ফোঁটা নাসারন্ধ্রে ফেলিতেছেন, কেহ আবার গোবর মাখিয়া দুধ ঢালিয়া স্নান করিতেছেন।
অন্য সময় এহেন কার্যকলাপকে শিক্ষার অভাব, এক শ্রেণির মানুষের অ-বৈজ্ঞানিক আচরণ বলিয়া উড়াইয়া দেওয়া চলে। কিন্তু অতিমারির সময় একটি গণতান্ত্রিক দেশের প্রশাসন স্বয়ং যখন ইহাতে পরোক্ষ প্রশ্রয় দেয়, তখন আশঙ্কা হয়, ইহার পশ্চাতে অন্য কোনও বৃহত্তর কু-মতলব আছে। আশঙ্কাটি অমূলক নহে। স্থানীয় প্রশাসনই এই কোভিড-কেন্দ্রটি চালাইবার অনুমতি দিয়াছে। শুধুমাত্র ইহাই নহে, গত এক বৎসর ধরিয়া বিজেপির নেতানেত্রীরা গোমূত্র এবং গোবর লইয়া নানা অমূল্য উপদেশ বিতরণ করিয়াছেন। কিন্তু ইহা যে সম্পূর্ণ অবৈজ্ঞানিক এবং যুক্তিজ্ঞানরহিত, তাহা বলিবার মতো প্রবল স্বর শীর্ষনেতৃত্বের গলায় শুনা যায় নাই। বরং কেন্দ্রীয় বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রক হৃষিকেশের এমস-কে কোভিড রোগীদের দ্রুত সুস্থ হইবার ক্ষেত্রে গায়ত্রী মন্ত্র জপ, প্রাণায়ামের প্রভাব লইয়া গবেষণার জন্য অর্থসাহায্য করিতেছে। পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য বিজেপির সভাপতি স্বয়ং গোমূত্র পানের সপক্ষে বলিয়াছিলেন। ভারতের ন্যায় দেশে অবৈজ্ঞানিকতাকে প্রশ্রয় দিবার একটি সুবিধা হইল, ইহার দ্বারা প্রায় বিনা পরিশ্রমে জনপ্রিয়তা পাওয়া যায়। কোভিড-১৯’এর প্রতিষেধকের যথাযথ বণ্টন লইয়া ভারতে বিজেপি সরকারের অপদার্থতা প্রকাণ্ড। চিকিৎসা পরিকাঠামো ক্ষেত্রের চিত্রটিও অনুরূপ। এমতাবস্থায় এই ‘বিকল্প চিকিৎসা পদ্ধতি’টি জনপ্রিয় হইলে সরকারের ক্ষতি নাই। বরং, কিছু মানুষের দৃষ্টি এই নিদারুণ সঙ্কট এবং সরকারি ব্যর্থতা হইতে অন্যত্র সরিতে পারে।
তবে সমস্ত দোষ সরকারের উপর চাপাইয়াও লাভ নাই। ফরাসি দার্শনিক জোসেফ দ্য মেস্ত্র্ একদা একটি মূল্যবান কথা বলিয়াছিলেন— মানুষ তাহার যোগ্য সরকারই পাইয়া থাকে। ভারতীয় নাগরিকদের এক বৃহৎ অংশ আজও ওঝা, গুনিন, তুকতাক, মাদুলি, কবচ-সহ নানাবিধ অবৈজ্ঞানিক কার্যকলাপের উপর আস্থা রাখে। অন্যথায় গোমূত্রের গুণাবলি জনপ্রিয়তা পাইত না। খাস কলিকাতার জোড়াসাঁকোতে বিজেপি নেতার কথায় গোমূত্রের ভাঁড় হাতে উঠিয়া আসিত না। ইহা শুধুমাত্র যে শিক্ষার অভাব তাহা নহে, ইহা যুক্তিবুদ্ধির অভাব, আরও সহজ ভাষায় বলিলে, কাণ্ডজ্ঞানের অভাব। ভারতীয় নাগরিকদের একাংশের মধ্যে এখনও এই কাণ্ডজ্ঞানের অভাব যথেষ্ট। এবং তাহার জন্যই ইহাদের ভুল বুঝানো সহজ। স্বৈরাচারী শাসকও সেই কারণে এই শ্রেণিটিকে পছন্দ করে, যে প্রশ্ন করিবে না, পাল্টা যুক্তি দেখাইবে না, বরং অন্ধ অনুকরণ করিবে। গোমূত্র পানের ঘটনাগুলিকে তাই বিচ্ছিন্ন বলিয়া উড়াইয়া দিবার উপায় নাই।