সহজ কথাটা সোজা ভাবেই বলেছেন সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতি এন ভি রমণা। প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে, দেশের বিভিন্ন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ও হাই কোর্টের বিচারপতিদের সম্মেলনে উচ্চারণ করেছেন ‘লক্ষ্মণরেখা’র কথা। কেন্দ্র বা রাজ্যের শাসক শিবির প্রায়ই অভিযোগ করে, আদালত সরকারের অধিকারে হস্তক্ষেপ করছে। সেই প্রসঙ্গেই প্রধান বিচারপতির দ্ব্যর্থহীন মন্তব্য: আদালতের রায় উপেক্ষা বা অমান্য করছে সরকার তথা প্রশাসন নিজেই, অন্য দিকে নাগরিকের কাছে সুবিচার ও আইনের ব্যাখ্যা পৌঁছে দিতে নীতিগত বিষয়ে মাথা ঘামাতে হচ্ছে আদালতকে। এই সবই হত না, যদি সংবিধানের অন্য দুই স্তম্ভ প্রশাসন ও আইনবিভাগ যে যার লক্ষ্মণরেখা মনে রেখে, পূর্ণ দায়বদ্ধতার সঙ্গে কাজ করত। আজকের ভারতে তা হচ্ছে না বলেই, প্রশাসন আইনমাফিক চলছে না বলেই বিচারবিভাগকে হস্তক্ষেপ করতে হচ্ছে।
প্রধান বিচারপতির এই কথাগুলি কেবল বর্তমান পরিস্থিতিরই পরিচায়ক নয়, সাংবিধানিক গণতন্ত্রের লালন ও রক্ষণেরও তা গোড়ার কথা। যার মূলে আছে এই স্বতঃসিদ্ধ: প্রশাসনের কাজ রাষ্ট্রের আইন অনুযায়ী কার্য নির্বাহ করা। সেই পরিপ্রেক্ষিতে শীর্ষ আদালতের প্রধান বিচারপতির তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষণ, ভারতের আদালতে মামলার পাহাড়ের দুই প্রধান কারণ— প্রশাসনের বিভিন্ন দফতরের নিষ্ক্রিয়তা, এবং আইনবিভাগের স্বীয় সামর্থ্যের পূর্ণ সদ্ব্যবহার না করা। এক দিকে প্রশাসন নিজেই আদালতের রায় ‘ইচ্ছাকৃত ভাবে উপেক্ষা’ বা ‘চূড়ান্ত অমান্য’ করছে, অন্য দিকে আইনবিভাগ আইন পাশ করছে যথেষ্ট সময় ও আলোচনা ছাড়াই, তাড়াহুড়ো করে— ফলে আইন থেকে যাচ্ছে অস্পষ্ট, স্বচ্ছ ব্যাখ্যাহীন। প্রশাসনের নিয়ম লঙ্ঘন ও ঔদ্ধত্যের জেরে এমনিতেই স্তূপীকৃত মামলার সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে আদালত অবমাননার মামলার অতিরিক্ত ভার ও চাপ; আবার আইনি সুরাহা না পেয়ে আদালতেরই শরণাপন্ন হচ্ছেন ক্ষুব্ধ নাগরিক, ফলে বিচারবিভাগকে মাথা ঘামাতে হচ্ছে নীতিগত বিষয়েও। নীতি নির্ধারণ করা বিচারবিভাগের কাজ নয়, কিন্তু প্রশাসন সে কাজটিও নিজে না করে সিদ্ধান্ত গ্রহণের দায় আদালতের দিকে ঠেলে দিলে, আইনের অস্পষ্টতায় বিভ্রান্ত সাধারণ মানুষ বিচারবিভাগের কাছে আর্জি জানালে তাকে হস্তক্ষেপ করতেই হবে, সেটাই ইতিকর্তব্য।
সহজেই বোঝা যায়, কেন আজকের ভারতে সমস্ত মামলার প্রায় অর্ধাংশই প্রশাসনকেন্দ্রিক, সরকারের নিষ্ক্রিয়তা বা অকর্মণ্যতার দিকেই আঙুল তোলে। সংবিধান নির্দেশিত ‘আইনের শাসন’ না থাকলে প্রশাসনের বিভিন্ন বিভাগ স্থিরলক্ষ্য হতে পারে না, তাদের অভ্যন্তরীণ ও পারস্পরিক স্বার্থসংঘাত তাই পৌঁছচ্ছে কাঠগড়ায়। এ কথা বুঝতে হবে, সংসদীয় স্থায়ী কমিটি বা সিলেক্ট কমিটিতে আলোচনা ও চুলচেরা বিচার-বিতর্ক ছাড়াই জবরদস্তি আইন পাশ হয়ে গেলে তা শুধু আইনবিভাগেরই বিপর্যয় নয়, সামাজিক বা রাষ্ট্রীয় গণতান্ত্রিক কাঠামোরও অবক্ষয়। বিচারবিভাগকে যে বারংবার, নিয়ম করে এই কথাগুলি বলে দিতে হচ্ছে তা একই সঙ্গে আশা ও আশঙ্কার। আশা, কারণ গণতন্ত্রের এই দুর্বিপাকে পথ দেখানোর, গোড়ার কথাটা বুঝিয়ে দেওয়ার মতো এখনও কেউ আছেন। আশঙ্কার, কারণ এত বার এত ভাবে বুঝিয়ে দেওয়ার পরেও প্রশাসনের মতি ফিরছে না।