অবশেষে কিছু ইতিবাচক ইঙ্গিত দেখা গেল ভারতের কূটনীতির পক্ষে। নরেন্দ্র মোদী সরকারের আমলে রাজনীতির সর্বাধিপত্যে অর্থনীতির মতোই দিগভ্রান্ত কূটনীতিও। ঘরোয়া রাজনীতির সমীকরণে আন্তর্জাতিক সম্পর্ককে মাপলে যে ফল ভাল হয় না, এই প্রজ্ঞা অবহেলা করায় নয়াদিল্লির কূটনৈতিক জমিও ক্রমশ পিচ্ছিল হয়ে উঠছিল। কিন্তু রুশ-ইউক্রেন যুদ্ধকালে ভারতের বিচক্ষণতা যে তাতে খানিকটা রাশ টানতে পেরেছে, তার প্রমাণ পাওয়া গেল আমেরিকার সঙ্গে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে। ইউক্রেন আক্রমণের পর আমেরিকা তথা নেটোর দেশগুলি যে ভাবে মস্কোর তীব্র নিন্দা করছে, অথবা একের পর এক অর্থনৈতিক অবরোধ গড়ে তুলছে, তাতে অংশগ্রহণ করতে দেখা যায়নি ভারতকে। নয়াদিল্লিও হিংসার পক্ষে নয়, কূটনীতি ও আলোচনাই তাদের মতে যথাযথ উপায়, তবে সে কথা স্বতন্ত্র পথেই জানিয়ে এসেছে তারা, রাষ্ট্রপুঞ্জেও সে অবস্থান বজায় থেকেছে। আন্তর্জাতিক মঞ্চে নিজস্ব চাওয়া-পাওয়ার হিসাবনিকাশ অনুসারে নিজ অবস্থানে দৃঢ় থাকাই জরুরি কর্তব্য— ভারত তাই এই জটিল সময়ে কূটনীতির জগতে আলাদা করে প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠেছে।
আমেরিকা ও রাশিয়া, দু’দেশের আচরণেই এর প্রমাণ। যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকেই কড়া রুশবিরোধী অবস্থান নেওয়ার জন্য ওয়াশিংটনের তরফে ভারতের উপর চাপ তৈরি করা হয়েছিল। ভারত তাতে সাড়া দেয়নি, এমনকি মস্কোর সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্কেও ছেদ ঘটায়নি। তৎসত্ত্বেও এই বৈঠকে আমেরিকান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন প্রতিরক্ষাক্ষেত্রে ভারতের রুশ-নির্ভরতা কমানোর ব্যাপারে তাঁদের সাহায্যের কথা বললেন, ইউক্রেনে ভারতের মানবিক সহায়তার প্রশংসাও করছেন। অন্য দিকে, বুচা গণহত্যা নিয়ে প্রধানমন্ত্রী মোদী উদ্বেগ প্রকাশ করলেও, রুশ বিদেশমন্ত্রী সের্গেই লাভরোভ ভারতের ‘নিরপেক্ষ বিদেশনীতি’— যা ‘আমেরিকা দ্বারা প্রভাবিত নয়’— তার প্রশংসা করেছেন। দুই পক্ষের এই ভারতপ্রিয়তার কারণ বোঝা কঠিন নয়। যুদ্ধে যে ভয়াবহ মানবিক ক্ষয়ক্ষতি হয়ে চলেছে, এখনও পর্যন্ত তা নিয়েই কথা বলেছে ভারত— আন্তর্জাতিক রাজনীতির দড়ি টানাটানিতে প্রবেশ করেনি। তা করার প্রয়োজনও ছিল না। নিজের ভূমিকাটুকু যথার্থ ভাবে পালন করেই গুরুত্বপূর্ণ হয়েছে নয়াদিল্লি।
জরুরিতর কথা, এই কাজ সহজ ছিল না। প্রতিরক্ষাক্ষেত্রে ভারত গভীর ভাবে মস্কোর উপর নির্ভরশীল, এবং তাকে চটালে রুশ-চিন অক্ষও নয়াদিল্লির পক্ষে বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। এ সব সামলেও ভারত যখন আন্তর্জাতিক ভাবে এক পোক্ত জমিতে দাঁড়াতে পারছে, তখন কূটনৈতিক মহলের শুধু প্রশংসাই প্রাপ্য নয়, তার উপর ভরসাও করা যায়। প্রশ্ন হল, এ বার কি তবে সামগ্রিক সংশোধনও সম্ভব? বিগত কয়েক বছরে দক্ষিণ এশিয়ায় যে ভাবে ভারতের প্রভাববৃত্তে ক্ষয় ধরেছে— ক্রমশ চিন-ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠেছে মলদ্বীপ, শ্রীলঙ্কা, বাংলাদেশ, নেপাল— সেখানে কি আবারও বলিষ্ঠ পদক্ষেপ করা যায়? ইউক্রেন যুদ্ধের কঠিন জমিতে যে দক্ষতার সঙ্গে এগোল ভারত, তা বজায় রাখতে পারলে এ কাজ অসম্ভব নয়। নিজের সুবিধাটুকু নজরে রেখে অন্যান্য রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন— এটাই কূটনীতির মূল কথা। স্বাভাবিক বুদ্ধি অনেক ‘কূট’ রাস্তাই সহজ করে দিতে পারে।