ভারতের সংবিধান বলে, এক জন প্রাপ্তবয়স্ক নাগরিকের পূর্ণ অধিকার আছে নিজ ধর্ম বাছিয়া লওয়ার। এই অধিকার সংবিধান-স্বীকৃত। সম্প্রতি এক জনস্বার্থ মামলার পরিপ্রেক্ষিতে কথাটি পুনরায় স্মরণ করাইয়া দিল ভারতের সুপ্রিম কোর্ট। প্রসঙ্গত, যে আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে এই রায়, তাহা ধর্মান্তরকরণ লইয়া। এক বিজেপি নেতা সুপ্রিম কোর্টে এই মর্মে আবেদন করিয়াছিলেন যে, আদালত যেন ধর্মান্তরকরণ রোধ করিতে কড়া কেন্দ্রীয় আইন প্রবর্তনের জন্য নির্দেশাবলি জারি করে। আবেদনটি লইয়া গভীর অসন্তোষ প্রকাশ করিয়াছে সর্বোচ্চ আদালত। এবং ইহাকে ‘অত্যন্ত ক্ষতিকর’ আখ্যা দিয়া সেই নেতাকে সতর্কও করিয়াছে।
এই সতর্কীকরণ সময়োচিত। কারণ, ভারতে রাজনৈতিক দিক হইতে নাগরিকদের সংবিধান-স্বীকৃত মৌলিক অধিকারগুলি প্রায় নিয়মিত লঙ্ঘিত হইতেছে। ভারত ‘ধর্মনিরপেক্ষ দেশ’ বলিতে শুধুমাত্র ইহা বুঝানো হয় না যে, এখানে বিভিন্ন ধর্মের মানুষ বাস করেন। ভারতীয় সংবিধান নাগরিকদের আরও কিছু অধিকার দিয়াছে। স্বেচ্ছায় নিজ ধর্ম বাছিয়া লওয়া যেমন সেই অধিকারের মধ্যে পড়ে, তেমনই নিজ ধর্ম প্রচারের স্বাধীনতাও তাহার অন্তর্ভুক্ত। দুর্ভাগ্য, এই উদারতা, সমন্বয়বাদিতা, এবং সর্বোপরি সহিষ্ণুতার আদর্শটি বর্তমানে ভয়ঙ্কর ভাবে বিপন্ন। ‘বলপূর্বক ধর্মান্তরকরণ’ রুখিবার নামে ব্যক্তিগত পরিসরে হস্তক্ষেপের এক প্রবল অপচেষ্টা পরিলক্ষিত হইতেছে। যেমন— উত্তরপ্রদেশ, গুজরাত-সহ একাধিক বিজেপি-শাসিত রাজ্যে ‘লাভ জেহাদ’-এর অজুহাতে ধর্মান্তরকরণ রুখিতে কড়া শাস্তির ব্যবস্থা করা হইয়াছে। শুধুমাত্র ধর্মই নহে, নাগরিক কী খাইবেন, কেমন পোশাক পরিবেন, কাহার সঙ্গে সম্পর্ক গড়িবেন— সমস্ত ধরনের ব্যক্তিস্বাধীনতাকে অগ্রাহ্য করিয়া নাগপুর-স্বীকৃত এক গোঁড়া হিন্দুত্ববাদী মতাদর্শ চাপাইবার প্রচেষ্টা নিরন্তর চলিতেছে। এমতাবস্থায় গণতন্ত্র এবং সংবিধান-প্রদত্ত অধিকারগুলি সুরক্ষিত রাখিবার জন্য মানুষের শেষ ভরসা সুপ্রিম কোর্টের উপর। সাম্প্রতিক বেশ কিছু রায়ে সুপ্রিম কোর্ট যে সেই সাংবিধানিক অধিকারগুলি স্মরণ করাইয়া দিয়াছে, তাহা সাধুবাদযোগ্য। সরকার যখন সংবিধান অমান্য করে, তখন বিচারালয়ই একমাত্র ভরসার জায়গা হইয়া উঠে।
আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বিচারপতি রোহিনটন এফ নরিম্যানের বক্তব্যে উঠিয়া আসিয়াছে। সংবিধানে যে ‘ধর্মপ্রচার’ শব্দটিকে জায়গা দেওয়া হইয়াছে, ইহার পশ্চাতে একটি সুনির্দিষ্ট যুক্তি আছে। অর্থাৎ, প্রত্যেক ভারতবাসীর নিজ ধর্ম পালন এবং সেই ধর্মের প্রতি অন্যদের উদ্বুদ্ধ করিবার সমান অধিকার আছে। রাষ্ট্র কোনও ভাবেই তাহাতে হস্তক্ষেপ করিতে পারে না। এবং সেখানে বলপ্রয়োগেরও স্থান নাই। এই কথাটি বিশেষ করিয়া বিজেপি সরকারের মনে রাখা প্রয়োজন। বলপূর্বক ধর্মান্তরকরণ বলিতে তাহারা সংখ্যালঘুদের উদাহরণ টানিয়া আনে। অথচ, নিজেদের ‘ঘর ওয়াপসি’-র কর্মসূচিটিও যে সেই বলপ্রয়োগেরই নামান্তর, সেই প্রসঙ্গ এড়াইয়া চলে। ইহা ঘোরতর অসাংবিধানিক। যিনি যে বিশ্বাসে স্থিত থাকিতে চাহেন, তাহাকে সেই রূপ থাকিতে দিতে হইবে, অন্য ধর্ম গ্রহণ করিতে চাহিলে সেই অধিকারও দিতে হইবে। তবেই সংবিধানের প্রতি সম্মান প্রদর্শিত হইবে। ধর্ম লইয়া যাঁহারা রাজনীতি করেন, তাঁহারা শুনিতেছেন কি?