—প্রতীকী চিত্র।
একশো বছর আগে রবীন্দ্রনাথ যে চিন ভ্রমণে গিয়েছিলেন, সে ঘটনার অনেক রকম তাৎপর্য ছিল, রবীন্দ্রজীবনে, এবং আরও বৃহত্তর অর্থে রবীন্দ্রনাথের সূত্রে বাংলার ভাবনাজগতে। ফলে এক বার শতবর্ষ আগের সেই ঘটনাকে ফিরে দেখা যেতে পারে। রাষ্ট্রশক্তির মত্ততা ও সভ্যতার প্রজ্ঞা এ-দুইয়ের পার্থক্য রবীন্দ্রনাথ প্রথম বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী কাল পর্বে নানা ভাবেই করে চলছিলেন। বলছিলেন যে, যখন রাষ্ট্রশক্তি মত্ত হয়ে ওঠে তখনই সভ্যতার সঙ্কট প্রকট হয়। এশিয়ার তিনটি প্রধান ‘রাষ্ট্র’ হিসাবে নয়, এশিয়ার প্রধান তিনটি ‘সভ্যতা’ হিসাবে তিনি ভারতবর্ষ, চিন ও জাপানের নামোল্লেখও করেছিলেন। চিন ও জাপান এই দুই দেশে ভ্রমণের সময় সেখানকার সভ্যতার প্রতি তিনি শ্রদ্ধানিষ্ঠ। চিন ও জাপান সফর তাঁর কাছে এক ভিন্ন অভিজ্ঞতার দরজা খুলে দিল, সেই দুই ভূখণ্ডের শাসকদের দেখলেন তিনি, রাষ্ট্রশক্তি হিসাবে আত্মপ্রকাশে তাঁরা কতই সচেষ্ট ও উদ্গ্রীব। সমালোচনা করলেন, সেখানে দাঁড়িয়েই। রবীন্দ্রনাথের এই সমালোচনা তাঁদের পক্ষে গ্রহণ করা কঠিন হয়েছিল। ফলে রবীন্দ্রনাথ সেখানকার প্রশাসক ও জনমণ্ডলীর কাছে আদৃত হননি। শুধু কি দেশের বাইরে চিন ও জাপান নিবাসীরাই রাষ্ট্রশক্তি সম্বন্ধে রবীন্দ্র-সমালোচনায় বিরক্ত? এ বিরক্তি ও বিরাগ তো ‘রবিবাবু’ সম্বন্ধে ভারতবর্ষীয়দেরও ছিল। রবীন্দ্রনাথের চৈনিক বন্ধুরা তাঁকে শ্রদ্ধাভরে ‘চু চেন-তান’ নামে ডাকতেন, অর্থ ভারতের বজ্র-নির্ঘোষী সূর্য। রবীন্দ্রনাথের বক্তৃতা রাষ্ট্রক্ষমতা বিরোধী বজ্রনির্ঘোষ। তিনি মনে করিয়ে দিয়েছিলেন, ‘অহংকার থেকেই নিজের সামর্থ সম্বন্ধে অন্ধবিশ্বাস তৈরি হয়, সেই অহংকারের মধ্যেই নিহিত থাকে বিচ্ছিন্নতা ও আত্মধ্বংসের বীজ। ...এশিয় সভ্যতা বিচ্ছিন্নতায় নয় সম্মিলনে বিশ্বাসী।’
রাষ্ট্র ও সভ্যতা এ-দুইয়ের পার্থক্য মূলত কোথায়? রবীন্দ্রনাথের বক্তৃতার সূত্রে বলা চলে রাষ্ট্র সমকালের সাফল্য ও লাভ-ক্ষতির হিসাব দ্বারা চালিত। প্রশাসকেরা রাষ্ট্রের নামে এই মুহূর্তেই সব কিছু দখল করে স্বদেশবাসীকে জগৎসেরা বলে প্রমাণ করতে চান। তাঁদের ক্ষমতার সিংহাসনে অধিষ্ঠান করতে হয় বলেই সমকালীন সময়ে কী ভাবে প্রতিষ্ঠা পাওয়া যায় তাই কেবল বিবেচ্য। দেশের সাম্প্রতিক চাকচিক্য প্রদর্শনই তাই রাষ্ট্রশক্তির লক্ষ্য। এই বর্তমানের চাকচিক্য প্রদর্শনের জন্য ভবিষ্যৎ যদি জলাঞ্জলি দিতে হয় তাও সই। প্রকৃতি ও অপরাপর মানুষের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে রাষ্ট্রশক্তি সমকালীনকে সত্য ও বাস্তব বলে দাবি করতে চায়। সেটুকু নিয়েই তার কারবার। অপর দিকে সভ্যতা সমন্বয়ের আদর্শে বিশ্বাসী। তা নদীর ধারার মতো, দু’পাশের মানুষ ও প্রকৃতি সেই জলধারায় পরিপুষ্ট। তা পারম্পর্যে বিশ্বাসী। সাহিত্য সম্বন্ধীয় আলোচনায় রবীন্দ্রনাথ শতাব্দীপ্রাচীন চৈনিক কবি লি পো-কে ‘আধুনিক’ কবি বলে গ্রহণ করেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের মতে লি পো-র কবিতা সাম্প্রতিকের খণ্ডতায় বিচ্ছিন্ন নয়। তাঁর কবিতার আধুনিকতা চিরন্তন আধুনিকতা। রাষ্ট্র বাস্তবতাবাদী। বর্তমানের ‘আধুনিক’ই তার বিবেচ্য। আর সভ্যতার মধ্যে থাকে ‘চিরন্তন আধুনিক’-এর বীজ। তা কাল থেকে কালান্তরে চলে।
শতাধিক বৎসর পূর্বে রবীন্দ্রনাথ চিন দেশে গিয়ে নানা সূত্রে রাষ্ট্র ও সভ্যতার প্রসঙ্গে যে কথাগুলি মনে করিয়ে দিয়েছিলেন, সেই কথাগুলি আবার নতুন করে ভাবার কারণ কী? এই মুহূর্তে ভারত ‘রাষ্ট্র’ হিসাবে প্রবল হয়ে উঠতে গিয়ে ‘সভ্যতা’র সমন্বয়ী দিকগুলিকে বহু ক্ষেত্রেই অস্বীকার করতে চাইছে। ভারতবর্ষীয় সভ্যতা সমন্বয়ী সভ্যতা। এই সমন্বয় বহুস্তরী। প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের সমন্বয়, এক ধর্মের সঙ্গে অপর ধর্মের সমন্বয়, ধনীর সম্পদের সামাজিক দায়িত্বের সমন্বয়ী ভাবনা সবই এর মধ্যে পড়ে। ভারতে এই সময় যে আত্মপরিচয়ের রাজনীতিকে রাষ্ট্রশক্তি বড় করে তুলছে তা সভ্যতার এই সমন্বয়ী ধারাটিকে বিনষ্ট করতে উদ্যত। বর্তমানের চাকচিক্য তা আপাত ভাবে বুঝতে না দিলেও সমন্বয়ের অভাব স্পষ্ট হয়ে উঠছে— এক গোষ্ঠীর সঙ্গে অন্য গোষ্ঠীর দূরত্ব ক্রমশ বৃদ্ধি পাচ্ছে। বিভিন্ন স্বার্থগোষ্ঠীর সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করাই রাষ্ট্রশক্তিকামী ভোট রাজনীতির লক্ষ্য। রবীন্দ্রনাথ চিন দেশের বক্তৃতায় জিশুর ধর্মীয় দর্শনের অনুষঙ্গে বলেছিলেন ‘দ্য মিক শ্যাল ইনহেরিট দি আর্থ’: দুর্বলরা এক দিন এই পৃথিবীর উত্তরাধিকারী হবে। এই মুহূর্তে ভারতীয় রাষ্ট্রবাদী রাজনীতি এই কথাটিকে যেন ভেংচি কাটছে, তাচ্ছিল্য করছে। উচ্চকণ্ঠ রাষ্ট্রবাদী রাজনৈতিকতার এই খণ্ডদর্শনকে নরেন্দ্র মোদী যুগের ভারতবর্ষীয় সভ্যতা শ্রেষ্ঠ পন্থা হিসাবে মেনে নিয়ে ক্ষমতাবিগলিত হয়ে আছে। রবীন্দ্র-প্রজ্ঞার তাৎপর্য সে দেশ বুঝবে কি?