ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গিয়েছে ব্রিকস সম্মেলন, আর দু’সপ্তাহ বাদেই নয়াদিল্লিতে জি২০ সম্মেলন। ভূরাজনৈতিক দিক থেকে ‘গ্লোবাল সাউথ’-এর অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ রাষ্ট্রের প্রধান নরেন্দ্র মোদীকে মহিমান্বিত করার যাবতীয় প্রস্তুতি চলছে। কিন্তু গোটা প্রক্রিয়ায় এখনও কাঁটার মতো বিঁধে রয়েছে চিন, এবং চিনের সূত্রে পূর্ব লাদাখের সীমান্ত সমস্যা। গলওয়ান উপত্যকায় সামরিক সংঘর্ষের পরে গত তিন বছরে অন্তত আঠারো বার দ্বিপাক্ষিক সামরিক স্তরের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়েছে সীমান্ত বিবাদ মেটাতে। কিন্তু কোনও বারই মেলেনি সমাধান। এমনকি যখন যৌথ বিবৃতিতে সীমান্তে শান্তি ও স্থিতাবস্থা বজায় রাখার প্রশ্নে একমত হয়েছে দুই তরফ, বেজিং-এর কথায় ও কাজের বিস্তর ফারাকটি স্পষ্ট থেকেছে। লক্ষণীয়, গলওয়ান-পূর্ব পর্বে ভারতের প্রধানমন্ত্রী চিন প্রেসিডেন্ট শি জ়িনপিং-এর সঙ্গে নানা বৈঠকে উপস্থিত হলেও, গত তিন বছরে সীমান্ত বিবাদ নিয়ে কোনও শীর্ষ বা পার্শ্ব বৈঠক হয়নি দুই রাষ্ট্রনেতার মধ্যে। জোহানেসবার্গ পৌঁছেও ব্রিকস বৈঠকে তাঁর অনুপস্থিতি নতুন করে সংশয় তুলে দেয়, আসন্ন জি২০ সম্মেলনে চিন-প্রধান শেষ পর্যন্ত যোগ দেবেন কি? যদি তিনি অনুপস্থিত থাকেন, তা হলে আন্তর্জাতিক মহলে ভারতীয় শীর্ষনেতার ‘দোর্দণ্ডপ্রতাপ ভাবমূর্তি’ ক্ষুণ্ণ হওয়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।
অন্দরমহলেও চাপের মুখে মোদী সরকার। গলওয়ানের পরে দেশের এক ইঞ্চিও চিনের দখলে নেই বলে প্রধানমন্ত্রীর দাবিকে সম্প্রতি মিথ্যাচার বলে লাদাখের মাটিতেই রাহুল গান্ধীর বিবৃতি অস্বস্তি বাড়িয়েছে তাদের। প্রসঙ্গত, সীমান্ত বিবাদের মতো স্পর্শকাতর বিষয়ে তথ্যের ক্ষেত্রে উপযুক্ত সতর্কতা জরুরি। কিন্তু গোটা সীমান্ত সঙ্কটকালে লাদাখ উপত্যকায় চিন সেনার অঞ্চল অধিগ্রহণ সংক্রান্ত তথ্য সংসদে বিরোধী দলনেতাদের সামনে কেন্দ্রীয় সরকারের পেশ না-করা মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়। যথাযথ গোপনীয়তা বজায় রেখেও এ কাজ করা যেত। সম্ভবত অদূর ভবিষ্যতে এই তথ্য-বিমুখতা ঘুচবে না, কেননা সামনেই বেশ কয়েকটি বিধানসভা নির্বাচন, এবং ২০২৪-এ লোকসভা নির্বাচন, সব ক’টিতেই শাসক দলের অস্ত্র হতে চলেছে নরেন্দ্র মোদীর ‘ইমেজ’। ইতিপূর্বে চিন এবং পাকিস্তানের কারণে ভারতের নিরাপত্তাকে এ-যাবৎ কালে যে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হতে হয়েছে, তা সামাল দেওয়া গিয়েছে তাঁর ভাবমূর্তির কারণেই— এমন ভাবনাকে মহা-আড়ম্বরে তুলে ধরা চলছে। সেই ভাবমূর্তি অক্ষুণ্ণ রাখতে লাদাখে চিনের অঞ্চল দখলের বিষয়টি গণচক্ষুর আড়ালে রাখা প্রয়োজন। তাই অধিকৃত অঞ্চলে চিন সেনা ছাউনি-সহ অন্যান্য পরিকাঠামো গড়ে তুললেও, সে বিষয়ে ভারতের সরকারি অবস্থান একটিই— নীরবতা।
পরিস্থিতি যেমন, তাতে ভারত-চিন সম্পর্কে বরফ গলার সম্ভাবনা অদূর ভবিষ্যতে ক্ষীণ। পরোক্ষ কূটনৈতিক সমাধানই এ ক্ষেত্রে উপযুক্ত পদক্ষেপ। জি২০-র প্রেসিডেন্ট পদ হয়তো ভারতকে একটি ছোট সুযোগ এনে দিয়েছে। তবে কিনা, সুযোগ তখনই অর্থময় যখন আন্তর্জাতিক বা দেশীয় ভাবমূর্তি রক্ষায় একটি সুবিবেচিত নীতি প্রণয়ন করা হয়। গলওয়ান সীমান্ত সংঘর্ষের মোকাবিলার রকম থেকে ইঙ্গিত, ততটা বিবেচনা এখনও সরকারি মহলে জায়গা পায়নি। উদ্বেগ এই কারণেই।