নবান্ন। —ফাইল চিত্র।
পশ্চিমবঙ্গের ত্রিস্তরীয় পঞ্চায়েত ব্যবস্থার বিশিষ্ট পদাধিকারীদের দক্ষতা বাড়াতে তাঁদের প্রশিক্ষণ দেবে আইআইএম এবং আইআইটি। জেলা সভাধিপতি ও সহকারী সভাধিপতিরা প্রশিক্ষণ পাবেন আইআইএম-এর অধীনে, আর জেলা সভাপতিরা আইআইটি-র বিশেষজ্ঞদের। বেহিসাবি খরচ নিয়ন্ত্রণ, স্বচ্ছতা, সময়ের যথোপযুক্ত ব্যবহার, দফতরে সুব্যবস্থার নিয়ন্ত্রণ এবং দলবদ্ধ ভাবে কাজ করার দক্ষতা— এই বিষয়গুলি রয়েছে শিক্ষাক্রমের তালিকায়। নব-নির্বাচিত পঞ্চায়েত সদস্যদের প্রশিক্ষণের নিয়ম বহু দিনের, কিন্তু শীর্ষ প্রতিষ্ঠানকে পঞ্চায়েতের সঙ্গে যুক্ত করার চেষ্টা এই প্রথম। কেন এর প্রয়োজন, প্রশ্ন করলে বলা চলে, কেনই বা নয়? গ্রামীণ স্তরে স্বায়ত্তশাসনের কাজটির গুরুত্ব অপরিসীম, কিন্তু বহু সদস্যের প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা যথেষ্ট নেই। অতএব যথাসম্ভব উৎকৃষ্ট প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করাই কর্তব্য। অপর দিকে আইআইএম এবং আইআইটি প্রশাসনের বিভিন্ন উদ্যোগের মূল্যায়ন নিয়মিত করে থাকে, এবং সেই অনুসারে নীতি প্রণয়নের পরামর্শও দিয়ে থাকে। ফলে তৃণমূল স্তরের প্রশাসনের সমস্যা, এবং সেগুলি কাটানোর উপায়, এ বিষয়ে যথেষ্ট জ্ঞানের সঞ্চয় রয়েছে এই প্রতিষ্ঠান দু’টিতে। প্রশাসনের কার্যকর্তাদের সঙ্গে শিক্ষক-গবেষকরা তা ভাগ করে নিলে সেই জ্ঞানের সদ্ব্যবহার হবে। ভুলে গেলে চলবে না, পশ্চিমবঙ্গে গ্রামীণ স্বশাসন নিয়ে যত পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছে, তার অন্তত একটির উৎস খড়্গপুর আইআইটিতে। গ্রামবাসীদের সহভাগী পরিকল্পনার কার্যসূচি শুরু হয়েছিল নব্বইয়ের দশকে। স্বল্পস্থায়ী হলেও বিকেন্দ্রিত স্বশাসনের ইতিহাসে তা স্বাক্ষর রেখে গিয়েছে। অতএব সেরা প্রতিষ্ঠানের প্রশিক্ষকদের গ্রামীণ প্রশাসনের উন্নতির কাজে নিযুক্ত করার ধারণাকে স্বাগত জানাতেই হয়।
তবে সাধারণ বুদ্ধির স্তরে যা সরল-সোজা, রাজনীতির জলে প্রবেশ করলে তাকেই যেন বাঁকা দেখায়। পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত এখন বিপাকে, কেন্দ্রীয় অনুদানের আকাল চলছে। একশো দিনের কাজ-সহ পঞ্চায়েতের নানা প্রকল্পে নানা অব্যবস্থা দর্শিয়ে কেন্দ্র টাকা বন্ধ করেছে। অভিযোগ উঠেছে হিসাবে গরমিল, টাকা নয়ছয়, প্রকল্পের বিধিভঙ্গ, লক্ষ্যপূরণে ব্যর্থতা প্রভৃতি গলদের। এই পরিস্থিতিতে পঞ্চায়েতের শীর্ষ কর্তাদের আরও বেশি প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা যেন ঘুরিয়ে এটাই ইঙ্গিত করে যে, তাঁদের জন্যই এই সব গোলযোগ হয়েছে, অতএব শুধরানো দরকার তাঁদেরই। এ যেন ‘উদোর পিণ্ডি বুধোর ঘাড়ে’ চাপানোর শামিল। কেন্দ্রীয় প্রকল্পের নাম বদলানো থেকে শুরু করে নানা বিধিলঙ্ঘন, বেহিসাবি খরচ, অস্বচ্ছতার দায় কি কেবল সভাপতি, সভাধিপতিদেরই? শীর্ষ রাজনৈতিক নেতাদের অঙ্গুলিহেলনের সামনে এই জনপ্রতিনিধিদের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাই বা কতটুকু? গত বছর দশকে পশ্চিমবঙ্গে পঞ্চায়েতের কর্তৃত্ব ক্রমাগত লাঘব হয়েছে, গুরুত্ব পেয়েছে জেলা প্রশাসন। রাজ্য প্রশাসনের নির্দেশ অনুসারে জেলা ও ব্লকের আধিকারিকরা প্রকল্পের রূপায়ণ করছেন। সেখানে পঞ্চায়েত প্রধান থেকে সভাধিপতি, কারও ইচ্ছার ছাপ দেখা গিয়েছে, এমন দৃষ্টান্ত বিরল। অথচ দেখা যাচ্ছে, ব্যর্থতার ভার বইবার বেলায় ভাঙা কুলোর মতো ডাক পড়ছে পঞ্চায়েতের। এই বিভ্রান্তির মোকাবিলা করার পথ প্রশাসনিক নয়, রাজনৈতিক। তার প্রশিক্ষণের জন্য বিশেষজ্ঞের দুয়ারে দাঁড়ালে হবে না, ফিরতে হবে মানুষের কাছে।