One Nation One Election

বহুদূরপ্রসারী

বিল আইনে পরিণত হলে দেশের গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়ায় বড় মাপের পরিবর্তন আসবে। একই সঙ্গে লোকসভা ও বিধানসভার ভোট সংঘটিত হবে, যা ১৯৬৭ সালের পর আর কখনও হয়নি।

Advertisement
শেষ আপডেট: ২০ ডিসেম্বর ২০২৪ ০৯:২৪
Share:

একই সঙ্গে সাংবিধানিক এবং আইনি বিতর্ক শুরু হয়েছে দেশ জুড়ে, ‘এক দেশ এক ভোট’ বিলটি নিয়ে। এর আগে কোনও সংস্কারেই ভারতীয় যুক্তরাষ্ট্র এবং গণতন্ত্র, উভয় ব্যবস্থার উপর এত ব্যাপক ও গভীর প্রভাবের আশঙ্কা করা হয়নি, ফলে জনসমাজ, গণমাধ্যম থেকে শুরু করে রাজনীতিবিদ, আইনজীবী, প্রাক্তন বিচারপতি সকলেই বিষয়টি নিয়ে উদ্বিগ্ন। এই বিল আইনে পরিণত হলে দেশের গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়ায় বড় মাপের পরিবর্তন আসবে। একই সঙ্গে লোকসভা ও বিধানসভার ভোট সংঘটিত হবে, যা ১৯৬৭ সালের পর আর কখনও হয়নি। সংবিধানে ৮২-ক নামে একটি ধারা সংযোজন করে বিলটিকে পাশ করাতে হবে, যে কাজ সহজ নয়। সংসদের দুই-তৃতীয়াংশ ভোটের ব্যবস্থা করে এনডিএ সরকার শেষ অবধি এটি পাশ করাতে পারবে কি না, দেখা যাক। রাখতে হবে রাষ্ট্রপতি-নির্ধারিত একটি সম্ভাব্য তারিখও, যে সময়ে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিতব্য সেই হিসাবে, এবং দেখতে হবে প্রাদেশিক নির্বাচন তার সঙ্গে কী ভাবে মেলানো যাচ্ছে। সব মিলিয়ে এটি অতিশয় জটিল সংস্কার প্রস্তাব, শেষ পর্যন্ত যা ফলপ্রসূ না-ও হতে পারে। তা সত্ত্বেও বিজেপি-নেতৃত্ব এই সংস্কার নিয়ে চূড়ান্ত উৎসাহী কেন, সেই প্রশ্নটির উত্তর স্পষ্ট হওয়া জরুরি।

Advertisement

উপরিতলের যুক্তি হল, ভারতের নির্বাচন ব্যবস্থার বিপুল অর্থব্যয় ও সময়ব্যয়ের নিরাময়ের পথ এই সংস্কার। জাতীয় ও প্রাদেশিক ভোট করতে এত সময় ও এত খরচ, এবং রাজনৈতিক দলগুলি সর্বদাই কোনও না কোনও নির্বাচনী প্রচারে এত ব্যাপৃত যে, দেশের প্রশাসনিক কার্যচালনার অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায় নির্বাচন। যুক্তিটিতে প্রভূত সমস্যা আছে, শেষ বিচারে এটি আত্মঘাতীও বটে, তবে একেবারে ফেলনা বলে একে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। ১৯৫১-৫২ সালের প্রথম নির্বাচন থেকে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত এমনই বিবেচনায় সমগ্র দেশে এক সঙ্গে ভোট হত। কিন্তু তার পর থেকে রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়তে থাকে, এক-এক প্রদেশে এক-এক রকম পরিস্থিতির উদ্ভব হয়, ভোট-ব্যবস্থা পাল্টাতে হয়। বিশেষ করে নানা রাজ্যে শরিকি সরকারের উদ্ভব এবং সেই সব সরকারের নিজস্ব বাধ্যবাধকতা কিংবা ব্যর্থতার কারণে ভিন্ন ভিন্ন সময়ে ভোট করা ছাড়া উপায় থাকে না। অর্থাৎ, জাতীয় দল হিসাবে কংগ্রেসের একক প্রতিপত্তি যখন থেকে ক্ষুণ্ণ হয়, তার পরই এক দেশ এক ভোট ব্যবস্থার বিলোপ হয়। এই যুক্তিকেই ঘুরিয়ে কেউ মনে করতে পারেন, ভিন্ন সময় ও ভিন্ন বাস্তবতার উপর বেশি জোর পড়ে বলেই জাতীয় স্তরের দল পূর্বাপেক্ষা খারাপ ফল করে পরবর্তী ব্যবস্থায়। এর থেকেই বোঝা সম্ভব, এই সংস্কারে বিজেপির অত্যুৎসাহের প্রকৃত কারণ। প্রদেশে প্রদেশে আঞ্চলিক দলের বর্তমান প্রাধান্যকে কমানো বা সরানোর আশাতেই তারা উজ্জীবিত। যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার মূলে কোপ মেরে এই সংস্কার চায় ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ।

এই বিল পাশ হলে ভারত হবে একটি ‘কেন্দ্রীভূত’ রাষ্ট্রব্যবস্থা, গণতান্ত্রিক বহুত্বের প্রশ্নটিও যার সঙ্গে অঙ্গাঙ্গি ভাবে জড়িত হয়ে যায়। বৃহৎ বহুসংস্কৃতি-সমৃদ্ধ দেশে এমন রাষ্ট্রীয় একত্ব নতুন করে প্রতিষ্ঠার অর্থই হল, নানা মত ও পথের প্রকাশপথে বাধা তৈরি করা। বাস্তবিক, এই সংস্কারের পিছনে বিজেপির উদ্দেশ্য-বিধেয় নিয়ে কোনও ধোঁয়াশা নেই, তাঁরা নিজেরাই স্পষ্ট করে দিচ্ছেন তাঁদের মনোগত বাসনা। অন্য দিকে, ভারতীয় জনসমাজের মনোগত বাসনাটি কী, তাদের নির্বাচিত দলগুলিই সংসদে তা প্রকাশ করবে। আপাতত একদলীয় স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আশঙ্কায় প্রায় সব বিরোধী দল এই বিল আটকানোর জন্য সরব। তবে সরবতা আর সফলতার মধ্যে অনেক দূরত্ব। তাঁরা কি অন্যান্য ক্ষেত্রের মতো আবারও সেই দূরত্ব অতিক্রমে অপারগ হবেন? তৃণমূল কংগ্রেস, ডিএমকে বা সমাজবাদী পার্টির কাছে এই বিল পাশ করতে সাহায্য চাইবে বিজেপি। এতই চাইবে যে, কোনও পাথর উল্টাতে বাকি রাখবে না। তখনও কি এই দলগুলি প্রতিরোধে অবিচল থাকবে?

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement