বাড়ির অজ্ঞাতে, বা জ্ঞাতসারেই, এক দিন উধাও হইয়া যায় নাবালিকা কন্যা। দালাল আসিয়া পাড়ার ছেলেদের দল বাঁধিয়া কাজে লইয়া যায় ভিন্রাজ্যে, ভিন্দেশে— তাহাদের মধ্যে কেহ ফেরে, কেহ প্রবাস হইতেই কুশল সংবাদ জানায়, কেহ বেমালুম উধাও হইয়া যায়। এই ছবিগুলি ভারতে অতিপরিচিত— মানব পাচারের ছবি। মানবাধিকারের ভয়াবহ উল্লঙ্ঘন ঘটে এই পাচারে। ব্যক্তির যাবতীয় অধিকার কাড়িয়া লওয়া হয়— কোনও কাজ না করিতে চাহিবার অধিকার, বসবাসের স্থান বাছাইয়ের অধিকার, এমনকি নিজের শরীরের উপর অধিকার। এই পাচারচক্র ঠেকাইতে ভারত কতখানি উদ্যোগী? আমেরিকার বিদেশ দফতরের একটি সাম্প্রতিক রিপোর্টে যে ছবি ফুটিয়া উঠিয়াছে, তাহা আশাপ্রদ নহে। ঘটনা হইল, পাচার ও দাসশ্রমের এক বিস্তৃত বাজার ভারতের ভিতরে ও বাহিরে কাজ করিতেছে। যৌনব্যবসার জন্য নারী ও বালিকা পাচারের বিষয়টি যতটুকু আলোচিত হইয়াছে, অপর নানাবিধ পেশায় বেগারশ্রমের জন্য পাচারের উপর ততটুকুও হয় নাই। মাঝেমধ্যে পূর্ব এশিয়া অথবা পশ্চিম এশিয়ার কোনও দেশ হইতে ভারতীয় শ্রমিকদের কার্যত দাসশ্রম হইতে উদ্ধার করিয়া আনিবার সংবাদ মিলে; কখনও বন্দি শ্রমিককে ক্রীতদাসের ন্যায় ব্যবহার করিবার নৃশংসতার খবর পাওয়া যায় দেশেরই হরেক ইটভাটা, খেত-বাগিচা, খনি-খাদান, কলকারখানা হইতে। বিবিধ স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার হিসাব একত্র করিলে আন্দাজ হয়, অন্তত আশি লক্ষ ভারতীয় পাচারের শিকার হইয়া কার্যত দাসত্বের জীবন কাটাইতেছেন। গোটা ছবিটি যে একটি কাঠামোগত গোলমালের ফল, সেই সামগ্রিক আলোচনা হয় না বলিলেই চলে।
এই সমস্যার প্রধান কারণ অবশ্যই দারিদ্র এবং অনুন্নয়ন। বহু ক্ষেত্রে শ্রমিক পরিবারগুলি ঋণবন্দি— নিয়োগকারী অথবা দালালরা অগ্রিম দিয়া তাঁহাদের শর্তবন্দি করে। বিকল্প রোজগারের উপায় তাঁহারা খুঁজিয়া পান নাই। নাবালিকা ও নারীদের ক্ষেত্রে পরিবারও বন্দিজীবনে বাধ্য করিয়া থাকে। এই ধারা দীর্ঘ দিনের। অতিমারির জন্য ভারতে যে বিপুল কর্মহীনতা এবং অর্ধাহার-অনাহারের পরিস্থিতির উদ্ভব হইয়াছে, তাহাতে পাচার, বিক্রয় এবং দাসশ্রমের ঝুঁকি বহু গুণ বাড়িয়াছে। অপর কারণ, সরকারি প্রকল্পের ব্যর্থতা। শিক্ষা, সমাজসুরক্ষা হইতে ক্ষুদ্রঋণ, নাগরিকের প্রাপ্য সকল সুবিধার বাহিরে আজও রহিয়া গিয়াছেন দেশবাসীর একটি বড় অংশ। দাসশ্রম তাঁহাদের বিপন্নতার হিমশৈলের কেবল চূড়ামাত্র। ফলে, দাসশ্রমকে কেবল আইনশৃঙ্খলার সমস্যা বলিয়া দেখিলেই হইবে না, শ্রমের অবমূল্যায়ন এবং শ্রমিকের নিরাপত্তাহীনতার বৃহত্তর সমস্যাটিও দেখিতে হইবে। লকডাউনের পরে পরিযায়ী শ্রমিকদের অবর্ণনীয় দুর্গতির চিত্র হইতে দেশবাসী আভাস পাইয়াছেন, গ্রাসাচ্ছাদনের ব্যবস্থা করিতে শ্রমজীবী মানুষকে কত দুর্গতি সহিতে হয়। বিশেষত অন্য জেলা, অন্য রাজ্যে কর্মরত শ্রমিক নাগরিক হইয়াও কার্যত ‘অবৈধ’ হইয়া থাকেন। শ্রমিকের আর্থ-সামাজিক প্রান্তিকতা, আহার-বাসস্থানের অনিশ্চয়তা হইতে পাচার, বন্দিদশা ও দাসশ্রমের দূরত্ব কতটুকু?
পাচার, বেগারশ্রম, যৌনব্যবসার চক্রের সহিত জড়িত অপরাধীদের গ্রেফতার ও শাস্তি বিধানেও কেন্দ্র ও রাজ্যগুলির শিথিলতা পরোক্ষে এই ব্যবস্থাকে দীর্ঘস্থায়ী করিতেছে। ২০১৯ সালে পাচারে অভিযুক্তদের তিয়াত্তর শতাংশ প্রমাণাভাবে বেকসুর খালাস পাইয়াছে। পাচারচক্রের শিকার পুরুষ-মহিলাদের ক্ষতিপূরণ দানে সরকারি দীর্ঘসূত্রতাও বিস্মিত করে। বস্তুত, প্রশাসনিক উদাসীনতা পাচারকারীদের সাহসী করিয়া তোলে। কেন্দ্র এ বৎসর পাচার প্রতিরোধে নূতন আইন প্রস্তাব করিয়াছে। উন্নত অস্ত্র লক্ষ্যবিদ্ধ করিবে যদি তূণ হইতে বাহির হয়। অনিচ্ছুক যোদ্ধার রণযাত্রা নিরর্থক।