অগ্নিকাণ্ড এবং বিষক্রিয়ার মতোই সমাজবিরোধীদেরও কখনও বাড়তে দিতে নেই। সুষ্ঠু প্রশাসনের এই মৌলিক এবং প্রাথমিক শর্তটি লঙ্ঘিত হলে কী ঘটতে পারে, পশ্চিমবঙ্গে সেটাই আরও এক বার প্রমাণিত। হাওড়া জেলায় যে সংগঠিত উপদ্রবের সূচনা, দেখতে দেখতে তা রাজ্যের অন্য একাধিক অঞ্চলে ছড়িয়েছে। সরকারের চালকরা এখন যত কড়া কড়া কথাই বলুন না কেন, পুলিশকর্তাদের বদলির নির্দেশ দিন না কেন, এ সবই প্রয়োজনের তুলনায় অতি সামান্য। অশান্তির প্রাথমিক লক্ষণ দেখেই তা প্রতিহত করতে তাঁরা যথেষ্ট তৎপর হলে, মুখ্যমন্ত্রী হাতজোড় করে শান্তিরক্ষার আবেদন না জানিয়ে কঠোর এবং নিরপেক্ষ ভাবে অশান্তি দমনের নির্দেশ দিলে— এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হত না। সুদীর্ঘ সময় ধরে রাস্তা অবরোধ করে এবং দিনের পর দিন হিংসাত্মক আচরণ করে যারা অগণন নাগরিকের চরম দুর্দশা ও ক্ষয়ক্ষতি ঘটায়, তাদের ধর্মীয় বা অন্য কোনও পরিচয়ই রাষ্ট্রের ধর্তব্য হতে পারে না, তাদের একমাত্র পরিচয়— তারা দুষ্কৃতী। যে অন্যায়ের বিরুদ্ধে তাদের এই ‘প্রতিবাদ’, তার গুরুত্ব ষোলো আনা স্বীকার করার পরেও এই পরিচয়টি ষোলো আনা সত্য। ধর্মদ্রোহী রাজনীতিকদের অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাতে সমাজবিরোধী তাণ্ডব চালালে সেটাও ভয়ঙ্কর অন্যায়। এই সত্যটি শুরুতেই স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করা উচিত ছিল।
শাসকদের অভিযোগ: এই তাণ্ডব স্বতঃস্ফূর্ত নয়, এর পিছনে অশুভ শক্তির ভূমিকা আছে। সঙ্গত অভিযোগ। যে ভাবে অবরোধ ও অশান্তির সূত্রপাত হয়েছে এবং যে ভাবে তা ছড়িয়ে পড়েছে, আবার তার প্রতিক্রিয়ায় যে পাল্টা অশান্তি সৃষ্টির তৎপরতা দেখা যাচ্ছে, তার কোনওটাই ‘স্বাভাবিক’ আবেগের প্রকাশ হতে পারে না, ঘটনাচক্রের পরতে পরতে অভিসন্ধি এবং চক্রান্তের লক্ষণ সুস্পষ্ট। এক দিকে সংখ্যালঘুর স্বার্থরক্ষার নাম করে জল ঘোলা করার বিপজ্জনক উদ্যোগ, অন্য দিকে সেই বিপদের ধারণাকে কাজে লাগিয়ে সংখ্যাগুরুর আশঙ্কায় ইন্ধন দিয়ে ঘোলা জলে মাছ ধরার তৎপরতা— দুই বিষাক্ত প্রচেষ্টার রসায়নে পশ্চিমবঙ্গের অশান্ত রাজনীতিতে সঙ্কটের নতুন মাত্রা যুক্ত হয়েছে। এটা খুবই তাৎপর্যপূর্ণ যে, বিধানসভা নির্বাচনে ব্যর্থতা এবং তার পরবর্তী অধ্যায়ে ক্রমাগত লোক-ক্ষয়ের ফলে যে রাজ্য বিজেপি গত এক বছরে নিতান্ত নিষ্ক্রিয় ছিল, এই অশান্তিকে কেন্দ্র করে কিন্তু তারা সহসা ‘উজ্জীবিত’ হয়ে উঠেছে। অন্য বিরোধী দলগুলিও ঘোলা জলে মাছ ধরতে নেমে পড়েছে। স্বাভাবিক রাজনৈতিক প্রাণশক্তি নয়, এ হল সাম্প্রদায়িক মেরুকরণের মাদক-প্রভাব, যার পরিণাম কত বিষময় হতে পারে সে-কথা বঙ্গসমাজ তার অতীত এবং সাম্প্রতিক ইতিহাসের কল্যাণে বিলক্ষণ জানে, কিন্তু রাজনৈতিক নেতারা সঙ্কীর্ণ স্বার্থের টানে কখনও সেই শিক্ষা মনে রাখেন না।
অথচ রাস্তা একটাই। পারস্পরিক দোষারোপ এবং বিভাজনের সর্বনাশা নির্বুদ্ধিতাকে বলিষ্ঠ প্রত্যয়ের সঙ্গে প্রত্যাখ্যান করে বিদ্বেষের কারবারিদের প্রতিহত করা। ব্যক্তি-নাগরিক, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, সামাজিক সংগঠন, রাজনৈতিক দল— সকলেরই তাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা থাকতে পারে, কিন্তু সরকার তথা শাসক দল সেই ভূমিকা যথাযথ ভাবে পালন করলে তবেই অন্যরাও কার্যকর হয়ে উঠতে পারে। এখানেই মুখ্যমন্ত্রী ও তাঁর সহকর্মীদের বড় দায়িত্ব। ক্ষুদ্র স্বার্থ এবং ভোটব্যাঙ্ক-আদি রকমারি হিসাবনিকাশের সঙ্কীর্ণ গণ্ডি অতিক্রম করে তাঁরা যদি যথার্থ রাজধর্ম পালন করতে পারেন, তবে এই অশান্তিপর্বের মোকাবিলার মধ্যে দিয়েই পশ্চিমবঙ্গে একটি সুস্থ রাজনীতির ভিত তৈরি হতে পারে। ‘মুখেন মারিতং জগৎ’ অনেক হয়েছে, আর নয়। এ ধরনের ঘটনা ঘটলে শেষ পর্যন্ত বিপন্ন হয়ে পড়বে রাজ্যের সংখ্যালঘু মানুষই— এই সার সত্য মনে রেখে সতর্ক পায়ে এগোনো জরুরি।
সবচেয়ে আগে সব খবর, ঠিক খবর, প্রতি মুহূর্তে। ফলো করুন আমাদের Google News, Twitter এবং Instagram পেজ।