টেকটনিক পরিবর্তন বলে ভূতত্ত্বে যে শব্দটি পড়া যায়, কালের গর্ভে সদ্য-বিলীয়মান বছরটিকে তেমন ভাবে দেখলে খুব ভুল হবে না। ইউক্রেনের যুদ্ধ, প্যালেস্টাইনের সংঘাত, ইরান-ইজ়রায়েল আক্রমণ প্রতি-আক্রমণ, আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রে ট্রাম্পের পুনরাগমন, দশকাধিক কালের ধ্বংসাত্মক গৃহযুদ্ধের পর সিরিয়ার প্রেসিডেন্টের পলায়ন, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর ক্ষমতাচ্যুতি, দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্টের ইম্পিচমেন্ট, এবং বছরের শেষ সপ্তাহে ইজ়রায়েল কর্তৃক পরমাণু-বোমা নিক্ষেপের অনুমান: সব মিলিয়ে যে পরিস্থিতিতে নতুন বছর পায়ে পায়ে প্রবেশ করল, তার মধ্যে টেকটনিক কম্পন অনুভব করা যেতেই পারে। আর এর সঙ্গে যদি কেউ যুক্ত করেন বিগত বছরটিতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অদম্য অগ্রগতি ও পরিবেশ সঙ্কটের উত্তরোত্তর মাত্রাবৃদ্ধি, তা হলে বোঝা সহজ, কেন নতুন করে মানব-ভবিষ্যৎ ভাবার প্রহর এখন। এতদুপরি, গণতান্ত্রিক পদ্ধতিমাফিক চলে যে যে দেশ, তাদের এক বড় অংশ গত বছর বুঝিয়ে দিয়েছে যে গণতন্ত্রমতেই বিদ্বেষ ও বিরোধনির্ভর সমাজ এখন ভবিষ্যৎ, দক্ষিণপন্থার রমরমা, ঐক্য ও সংহতির বদলে আক্রমণ ও দমনের পথই এখন জন-প্রিয়।
এ যদি হয় সমাজ-রাজনীতির ছবি, বিশ্ব জুড়ে অর্থনীতির ক্ষেত্রেও ২০২৫ সাল যে বিশেষ ভাবে টালমাটাল থাকতে চলেছে, তার চিহ্নও বেশ স্পষ্ট। আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের নতুন ট্রাম্প রাজত্বের সূচনাই হয়তো হতে চলেছে যুগান্তকারী। আমদানির ক্ষেত্রে শুল্ক বাড়িয়ে, বিশেষ করে চিনা সামগ্রীর ক্ষেত্রে বড় পরিবর্তন আসতে পারে। এমনিতেই চিনের অর্থনীতির হাল নিয়ে প্রশ্ন উঠতে শুরু করেছে। ইউক্রেন এবং পশ্চিম এশিয়ায় সংঘাত ও যুদ্ধের অভিঘাতে বিশ্ববাণিজ্য সঙ্কটকে আরও খানিকটা বাড়িয়ে এ বারও নতুন করে মন্দা আনতে পারে, এবং তার সূত্রে অদম্য হয়ে উঠতে পারে রক্ষণশীল রাজনীতির সার্বিক প্রসার— সে আমেরিকাতেই হোক, কিংবা জার্মানিতে বা ফ্রান্সে। ডলার হয়তো আরও শক্তিশালী হবে, এবং তার ফলে আমদানি-নির্ভর যে সব দেশ, তাদের উপর আর্থিক চাপ বাড়বে। কোভিডের ধাক্কা থেকে এখনও পুরোপুরি বেরোতে না পারা উন্নয়নশীল দেশগুলির জন্যও সামনের দিনগুলো উজ্জ্বল বলে মনে হয় না। আছে জলবায়ু পরিবর্তনের ধাক্কা: ট্রাম্পীয় বিশ্ববীক্ষা এত দিন পরিবেশ পরিবর্তনকে ‘মিথ’ কিংবা মিথ্যা যা-ই দাবি করুক না কেন, লড়তে থাকা দেশগুলিকে আরও বেসামাল করতে পারে বিশ্ব উষ্ণায়নের দীর্ঘমেয়াদি প্রভাব।
ভারতের মাটিতেও উঁকি দিচ্ছে একাধিক বড় পরিবর্তনের সম্ভাবনা। ইতিমধ্যেই গত বছরের লোকসভার ক্ষতিকে মিটিয়ে লাভের খাতা ভরতে শুরু করেছে বিজেপি। সঙ্গতে সতর্ক ও সক্রিয় হয়েছে শতবর্ষী আরএসএস। যে হিন্দুত্ব গোষ্ঠী একশো বছর ধরে অবিরত সন্তর্পণে নিজের কাজ করে গিয়েছে, এই বছরও হয়তো দৃষ্টির অন্তরালেই তারা নানা ধরনের গুরুত্বপূর্ণ সাংগঠনিক পরিবর্তন আনবে, সম্ভাবনা এমনই। ইতিমধ্যে বাংলাদেশের নবোদ্ভূত অসহিষ্ণু রাজনীতির কারণে সীমান্ত অঞ্চলে অস্থিরতা বাড়তে পারে, এবং তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাড়তে পারে সংখ্যাগুরুবাদের দাপট। ভারতীয় অর্থনীতির সঙ্কটাপন্ন অবস্থা এই পরিবেশে অতিরিক্ত স্ফুলিঙ্গ জোগাতে পারে, আশঙ্কা রইল। গত বছরটির শেষ দিকে বৃদ্ধিহার যে পর্যায়ে নেমেছিল, তার থেকে কোনও উত্তরণ সম্ভব কি না, তার জন্য আগামী বাজেটের প্রত্যাশায় রয়েছে ভারতীয় অর্থনীতি। এই পরিপ্রেক্ষিতেই পশ্চিমবঙ্গ তৈরি হবে পরের বিধানসভা নির্বাচনের জন্য। আর জি কর ঘটনা-পরবর্তী নাগরিক আন্দোলন যেমন রাজ্য রাজনীতিতে আশার উদ্ভাস, তেমনই সাম্প্রতিক সাম্প্রদায়িক আস্থাসঙ্কট রাজনীতিকে বিপদ-আবর্তে টেনে নিয়ে যেতে পারে, এ এক বিরাট আশঙ্কা। এই দোলাচলের মধ্যে শুভ সমাজবোধ ও সুস্থ সংস্কৃতি ভাবনা নাগরিক সমাজকে চালনা করবে, বছরের প্রথম সূর্য কি সেই আশ্বাস দিচ্ছে?