প্রতীকী ছবি।
দুর্গোৎসব আগতপ্রায়। অঞ্জলির মন্ত্রে ভক্তের বাৎসরিক প্রার্থনা, ‘ধনং দেহি’। রাজ্যের প্রাক্তন বিধায়কেরা জোট বাঁধিয়া যেন তাহারই আগমনী শুনাইলেন! নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা বেতন, ভাতা ও বিবিধ সুযোগ-সুবিধার বিনিময়ে জনগণের ‘সেবা’ করিয়া থাকেন! তাই বিধায়ক বা সাংসদ পদের অবসান ঘটিলেও আজীবন পেনশন, নির্দিষ্ট পরিমাণ চিকিৎসার খরচ ইত্যাদি তাঁহাদের জন্য বরাদ্দ। কিন্তু নাল্পে সুখমস্তি। অতএব সেই প্রাপ্যের পরিমাণ দ্বিগুণেরও বেশি বৃদ্ধি করিবার দাবিতে এই রাজ্যের প্রাক্তন বিধায়কেরা এই বার জোট গড়িলেন— ‘এক্স-মেম্বার্স ওয়েলফেয়ার অ্যাসোসিয়েশন’। সাধারণত জোট-রাজনীতিতে কে কাহার সঙ্গ লইবেন, কে কাহার সহিত এক পঙ্ক্তিতে বসিবেন, তাহা দলগুলির নিজ নিজ স্বার্থের অঙ্ক ও রসায়নের উপর নির্ভর করে। পরিস্থিতি ভেদে অবস্থানের বদলও ঘটে। কিন্তু পাওনার দাবিতে সকলের এক ‘রা’ শুনিতে পাওয়া এই ক্ষেত্রে অসম্ভব নহে বলিয়াই প্রতীয়মান। যদিও শাসক তৃণমূল এখনও ইহাতে শামিল হয় নাই। বিজেপিও নয়। বামফ্রন্ট শরিকেরা কংগ্রেসকে সঙ্গী করিয়াই আপাতত অবতীর্ণ। তাঁহাদের চাহিদা, মাসিক পেনশন ১২ হাজার হইতে বৃদ্ধি করিয়া ২৫ হাজার এবং চিকিৎসা ভাতা ৬ হাজারের পরিবর্তে ১৫ হাজার। প্রসঙ্গত, কেহ ন্যূনতম পাঁচ বৎসর সাংসদ থাকিলেও অবসরকালীন ২৫ হাজার টাকার পেনশন ভোগ করিতে পারেন।
বিষয়টির দুইটি দিক আছে। এক, অর্থের প্রয়োজন; এবং দুই, সাধারণ মানুষের ধারণা। বর্তমান সময়ে সংসারযাপনের কথা বিবেচনা করিলে পেনশনের পরিমাণ খুব বেশি বলা হয়তো অসমীচীন। কিন্তু জনপ্রতিনিধিদের সম্পর্কে জনগণের মনে যে ছবি প্রতিনিয়ত আঁকা হইতেছে, তাহার সহিত ওই দাবির সাযুজ্য খুঁজিতে গেলে কোথাও সংশয়ের মেঘ জমিতে পারে। কারণ, বিধায়ক তো দূরস্থান, পঞ্চায়েতে ক্ষমতাসীন হইবামাত্র এক-এক জনের অঙ্গুলি কী ভাবে কদলী-বৃক্ষের ন্যায় স্ফীত হইয়া উঠে, পর্ণকুটির অচিরে বহুতল অট্টালিকার আকার নেয়, সাইকেলের বদলে দুয়ারে মোটরগাড়ি বাঁধা থাকে, তাহা প্রমাণ করিতে রকেট-বিজ্ঞান লাগে না। মানুষের নিত্য অভিজ্ঞতাই যথেষ্ট। আর্থিক দুর্নীতির যে সব অভিযোগ আমাদের পরিপার্শ্বকে নিয়ত চঞ্চল করিয়া তুলিয়াছে, তাহারও প্রায় সব কয়টির নিশানায় বিধায়ক, সাংসদের মতো জনপ্রতিনিধিরা। জনসেবার নেপথ্যে রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ তো আছেই। যদিও সকলকে এক মাপকাঠিতে বিচার করা সঙ্গত নহে। কিন্তু একটি শ্রেণি যখন কলঙ্কিত বলিয়া চিহ্নিত হয়, তখন ‘সৎ’ বাছিতে গাঁ উজাড় করা কঠিন হইয়া দাঁড়ায়। আর এই কথাও ঠিক যে, ‘পারসেপশন’ সদাই ‘রিয়ালিটি’ অপেক্ষা অধিক প্রভাবশালী। তাই পাঁচ বৎসর বিধায়ক বা সাংসদগিরি করিবার পরে বিশ-পঁচিশ হাজার টাকা পেনশনের উপর নির্ভরতা কত দূর যুক্তিগ্রাহ্য, সেই প্রশ্নটি থাকিয়াই যায়।
বর্তমানে এই রাজ্যে এক জন বিধায়কের মূল বেতন ও ভাতা ধরিলে মাস মাহিনা প্রায় ২২ হাজার টাকা। বিভিন্ন কমিটির বৈঠক বাবদ মাসিক রোজগার আরও ৬০ হাজার। অর্থাৎ, একুনে ৮২ হাজার। সাংসদদের ক্ষেত্রে মূল বেতন মাসিক এক লক্ষ। নির্বাচন কেন্দ্রের খরচ বাবদ আরও ৬০ হাজার। অফিস খরচ ২০ হাজার। রাজ্যসভার সদস্যদের নিজস্ব নির্বাচন কেন্দ্র না থাকিলেও প্রাপ্যে বিভেদ নাই। কিন্তু প্রশ্ন হইল, কোনও না কোনও দলের প্রতিনিধি হইয়া যাঁহারা বিধানসভায় বা সংসদে যান, অবসরের পরেও তাঁহাদের চিরকালীন ভরণপোষণের দায় রাজকোষ বহিবে কেন? সকলের প্রয়োজন তো সমান নহে। সেই দিক বিবেচনা করিয়া সংশ্লিষ্ট দলগুলির উচিত নিজেদের তহবিল হইতে উচিত মতো অবসরপ্রাপ্ত জনপ্রতিনিধিদের সংসার নির্বাহের বন্দোবস্ত করা। তাহাতে তৈলাক্ত মাথায় তৈলমর্দনের আতিশয্যও কমিবে।