জি-৭’এর মতো ‘অভিজাত গোষ্ঠী’-র সম্মেলনে প্রবেশাধিকার পাওয়া কম কথা নয়। গত দু’দশকে ভারতের বেশ নিয়মিত এই অধিকার জুটেছে বিশেষ অতিথি হিসাবে। এর মূলে রয়েছে বিশ্বের উন্নত অর্থনীতির দেশগুলির সঙ্গে ভারতের ক্রমবর্ধমান আর্থিক ও কূটনৈতিক সম্পর্ক এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক বিষয়ে ‘অপ্রয়োজনীয়’ হস্তক্ষেপ না করার নীতি। নিঃসন্দেহে এই ধরনের সম্মেলনে উপস্থিতি ভারতের কূটনীতিকে অনেক সাবালক হওয়ার জন্য উদ্দীপনা এনে দিয়েছে, পশ্চিমের উন্নত দেশগুলির সঙ্গে ভূ-রাজনৈতিক সম্পর্ক আরও দৃঢ় করতে সাহায্য করছে। এ বছরের সম্মেলনটিতেও ভারত সেই অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়নি। ভারতের পক্ষে সেটা যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ, কেননা এ বারের মূল আলোচ্য বিষয় ছিল রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। জি-৭’এর সদস্যরা রাশিয়ার ইউক্রেন-হামলাকে ‘অনৈতিক’ এবং ‘অযৌক্তিক’ বলে ভর্ৎসনা করে যখন তার বিরুদ্ধে আরও কড়া পদক্ষেপের পাশাপাশি ইউক্রেনের পাশে সক্রিয় ভাবে দাঁড়ানোর প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে— ভারত যে তাদের সুরে সুর মেলাতে চাইবে না, এ কথা তাদের অজানা ছিল না। মধ্যপন্থা অবলম্বন করে ভারত যে রাশিয়ার সঙ্গে আলোচনা এবং কূটনীতির মাধ্যমে ইউক্রেনের সঙ্গে বিবাদ মিটিয়ে নেওয়ার উপরেই জোর দেবে, অজানা ছিল না তাও। তবু যে আমন্ত্রণ প্রত্যাহৃত হয়নি— এই ঘটনাকে হয়তো ভারতের কূটনৈতিক গুরুত্বের চিহ্ন হিসাবে ধরা যেতে পারে।
সম্মেলনে রাশিয়ার উপরে আন্তর্জাতিক স্তরে রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ভাবে আরও বেশি চাপ সৃষ্টি করার প্রতিশ্রুতি দিল জি-৭। গোষ্ঠীর সদস্যরা আমেরিকা, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, ব্রিটেন এবং জি-৭’এর সদস্য দেশগুলি বাদে যে সব দেশে রাশিয়া অপরিশোধিত তেল এখনও রফতানি করছে, তা আটকানোর জন্য এক বিশেষ পদক্ষেপের পরিকল্পনা করছে। তদনুযায়ী, এই তেলের দাম আন্তর্জাতিক স্তরেই বিশেষ ভাবে বেঁধে দেওয়া হবে, যাতে রাশিয়া এই রফতানি থেকে সে ভাবে মুনাফা অর্জন না করতে পারে। তা ছাড়া রাশিয়ার সমুদ্রপথে তেল এবং পেট্রোপণ্য অন্যান্য দেশে রফতানিকেও নিষিদ্ধ করে সে দেশকে কোণঠাসা করতে চাইছে আমেরিকা-সহ জি-৭ সদস্যরা।
বিশ্বমঞ্চে এই মুহূর্তে ক্ষমতার ভারসাম্য ও অর্থনৈতিক স্থিতি, দুই-ই দোদুল্যমান। আগামী দিনে এক দিকে রাশিয়া ও নেটো-র মধ্যে বিবাদ এবং অন্য দিকে, দক্ষিণ চিন সাগরে চিন এবং আমেরিকার মধ্যে সংঘাত আরও উত্তপ্ত হওয়ার সম্ভাবনা। দু’টি ক্ষেত্রেই মধ্যবর্তী অবস্থায় রয়েছে ভারত। ইতিমধ্যেই বেশ কিছু ক্ষেত্রে দিল্লিকে মধ্যপন্থাকামীর ভূমিকা পালন করতে দেখা গিয়েছে। জি-৭ সম্মেলনের আগেই অনুষ্ঠিত ব্রিকস সম্মেলনে, রাশিয়া এবং চিনের আমেরিকাবিরোধী প্রচারের সুর নামাতে ভারত সরব হয়। আবার একই ভাবে, জি-৭ সম্মেলনেও সেই সব চুক্তিপত্রেই ভারত স্বাক্ষর করে যাতে চিন বা রাশিয়া বিরোধী কোনও মন্তব্য নেই। অর্থাৎ, বিশ্ব কূটনীতিতে ভারতের মধ্যবাদী পরিচিতি যথেষ্টই স্বীকৃতি পেয়েছে। আন্তর্জাতিক স্তরের ক্ষমতা-যুদ্ধ এখন যে স্তরে, তাতে এই স্বার্থবোধ-প্রণোদিত মধ্যবাদ পালন করা বিশেষ জরুরি। ভারতীয় কূটনীতি আপাতত ঠিক রাস্তাতেই চলছে— চতুর্দিকের সংঘর্ষময় পরিস্থিতিতে যা কম কথা নয়!