ফাইল চিত্র।
অবশেষে প্রধানমন্ত্রীও কালীকীর্তনে যোগ দিলেন। বেলুড় মঠের প্রসঙ্গ নরেন্দ্র মোদীর মুখে আগেও একাধিক বার শোনা গিয়েছে। কিন্তু রবিবারের স্মৃতিচারণে যে ভাবে তাঁর দৃষ্টি ভাগীরথী পার হয়ে দক্ষিণেশ্বরের কালীমন্দিরে গিয়ে পড়ল, তেমনটা আগে ঘটেছে কি? ভক্তজনে বলবেন, আগে ঘটেনি বলে কি এখন ঘটতে পারে না? নিশ্চয়ই পারে। তবে কিনা, সংশয়ী নাগরিক ভাবতেই পারেন— প্রধানমন্ত্রীর এই সুভাষিতাবলির অনুপ্রেরণা কি দেবী ভবতারিণী, না মানবী মহুয়া মৈত্র? কালী বিষয়ে তৃণমূল কংগ্রেসের এই সাংসদের মন্তব্য নিয়ে গত কয়েক দিন ধরে যে শোরগোল চলছে, তার পিছনে জল ঘোলা করার পরিচিত রাজনীতি নিতান্তই নিরাবরণ। কেবল দেবীর এবং তাঁর ভক্তদের অপমানের অভিযোগে প্রতিবাদ বিক্ষোভ কটূক্তি নয়, বিজেপি শাসিত বিভিন্ন রাজ্যে পুলিশের থানায় সাংসদের বিরুদ্ধে নালিশের স্রোত বইছে, পশ্চিমবঙ্গের বিজেপি নেতারা নিয়ম করে তাঁর মুণ্ডপাত করছেন, দিল্লি থেকে সমাগত নায়কনায়িকারাও প্রবল উৎসাহে সেই বৃন্দগানে যোগ দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রীর কালীবন্দনা কি সেই তৎপরতায় নতুন ইন্ধন দেবে না? ইন্ধন দেওয়াই কি এই বন্দনার উদ্দেশ্য ছিল না? উত্তর জানা হোক বা না হোক, প্রশ্নগুলো সহজ।
কেন জল ঘোলা করার এই ব্যগ্রতা, সে-প্রশ্নও কঠিন নয়। নাগরিকরা ক্রমাগত এ-জিনিস দেখে আসছেন। দারিদ্র অশিক্ষা অস্বাস্থ্য বেকারত্ব মূল্যস্ফীতি আদি অজস্র সমস্যায় দেশের মানুষ নাজেহাল, অতিমারির অভূতপূর্ব সঙ্কট তাঁদের দুর্দশাকে চরমে নিয়ে গিয়েছে, রাজনৈতিক দল এবং তাদের নেতাদের কর্তব্য ছিল সেই সঙ্কটের মোকাবিলায় সর্বশক্তি প্রয়োগ করা, মা কালী এবং অন্য দেবদেবীরাও তাতে খুশিই হতেন। কিন্তু রাজনীতির কারবারিরা দেবলোক নিয়ে চিন্তিত নন, তাঁদের লক্ষ্য মর্তলোকের ক্ষমতা। অযোধ্যার রাম, মথুরার কৃষ্ণ, কাশীধামের শিবের মতোই বাংলার কালীও বোধ করি সেই লক্ষ্য সাধনের উপায়মাত্র। কে এই দেবী, কী তাঁর সৃষ্টিছাড়া রূপ এবং আচরণের তাৎপর্য, তাঁর সঙ্গে অগণন বাঙালির ভয়, ভক্তি এবং ভালবাসার সম্পর্কটি কেমন— এই সব বিষয়ে ওই সঙ্কীর্ণ রাজনীতির সওদাগররা কিছুই জানেন না, জানার কোনও বাসনাও সম্ভবত নেই, কারণ জানলে এমন নির্বোধ শোরগোল চালানো কঠিন হয়। চূড়ান্ত অজ্ঞতা এই কু-রাজনীতির বড় মূলধন।
সেই কারণেই মহুয়া মৈত্র যখন বিজেপির চিৎকারকদের উদ্দেশে বলেন, তিনি নিজের কথার সত্যতা এবং যৌক্তিকতার প্রমাণ দিতে পারেন, তখন ভুল বলেন না। তথ্য এবং যুক্তি অবশ্যই তাঁর পক্ষে আছে। তবে যথেষ্ট বিচক্ষণতার পরিচয় তিনি দিতে পারেননি। রাজনীতিক এবং জনপ্রতিনিধি হিসাবে বাক্স্বাধীনতা এবং মতপ্রকাশের অধিকার কখন কী ভাবে কতটা প্রয়োগ করবেন, সেটাও তাঁর ভাবা দরকার ছিল। যে পরিবেশ চার পাশে তৈরি হয়ে আছে, তাতে এমন উক্তি নিয়ে কদর্য এবং বিপজ্জনক ‘খেলা’ শুরু হবে, সেটা কার্যত অবধারিত ছিল। শাসকদের প্রকৃত সমালোচনা, প্রতিবাদ এবং প্রতিরোধের যে দায়িত্ব বিরোধী রাজনীতিক হিসাবে পালন করা তাঁর কর্তব্য, এই ধরনের শোরগোল তার পরিপন্থী হয়ে উঠতে বাধ্য। এখানেই সংযমী বিচক্ষণতার প্রশ্ন। এই পরিপ্রেক্ষিতেই তাঁর দল এই বিতর্ক থেকে নিজেকে দূরে রাখতে চাইছে। সেটা অসঙ্গত নয়। তবে একই সঙ্গে বাক্স্বাধীনতার পক্ষে দলের স্পষ্ট অবস্থান নেওয়ার প্রয়োজন ছিল, এ-পর্যন্ত সেই বলিষ্ঠতা তারা দেখায়নি। ‘ভাবাবেগে আঘাত দেওয়া’র ভয়ে গণতান্ত্রিক অধিকারের প্রশ্নটিকে এড়িয়ে চললে ধর্মাশ্রিত রাজনীতির ব্যাপারীরাই কিন্তু সুবিধা পেয়ে যাবেন। তাঁরা প্রতিনিয়ত সুযোগ খুঁজছেন।