কৃষক আন্দোলন চলিতেছে চার মাস, মৃত্যু হইয়াছে তিন শত কৃষকের, আলোচনা ব্যর্থ হইয়াছে এগারো বার। সম্প্রতি পুনরায় চাষিদের আলোচনায় বসিতে আহ্বান করিয়াছেন কৃষিমন্ত্রী নরেন্দ্র সিংহ তোমর। তবে শর্ত— সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব লইয়া বসিতে হইবে। কৃষকরা জানাইয়াছেন যে, আলোচনায় বসিতে তাঁহারা রাজি, কিন্তু বিতর্কিত কৃষি আইন বাতিলের দাবিতে তাঁহারা অনড়। অতএব আশঙ্কা, করোনার দ্বিতীয় ঢেউ মাথায় করিয়া সিঙ্ঘু সীমান্তে অবস্থান করিয়া চলিবেন কয়েক লক্ষ কৃষক। প্রবল শীতে মৃতদের সহিত যোগ হইবে প্রচণ্ড গরমে আক্রান্তদের সংখ্যা। কেন্দ্রীয় সরকার অথবা কৃষক আন্দোলন— কাহার দাবি যুক্তিযুক্ত, কোন দাবিগুলি গ্রহণযোগ্য আর কোনটি নহে, সেই বিতর্ক আরও বহু দিন চলিবে। কিন্তু সর্বাগ্রে প্রশ্ন করিতে হইবে যে, এক শত দিন পার করিয়াও কেন এমন অচলাবস্থা চলিতেছে? একটি গণতান্ত্রিক দেশে কী করিয়া আলোচনা এতটাই অসম্ভব হইয়া উঠিল? উত্তরে আঙুল উঠিবে নরেন্দ্র মোদীর সরকারের প্রতি। সংসদে যথেষ্ট আলোচনা ও বিতর্কের অবকাশ না দিয়াই পাশ হইয়াছে তিন কৃষি আইন, কৃষক তাঁহার সংশয়-আশঙ্কা ব্যক্ত করিতে পারেন নাই, প্রশ্নের উত্তর পান নাই— এই সত্য কোনও মতেই অস্বীকার করা চলিবে না। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিরা যথাস্থানে, যথাযথ পদ্ধতিতে বক্তব্য পেশ করিতে পারিলে সিঙ্ঘু সীমান্তে চাষিদের অবস্থানের প্রয়োজন হইত না। অচলাবস্থা ভাঙিতে তাঁহাদের বার বার আহ্বানও করিতে হইতে না।
আলোচনার জন্য প্রয়োজন পারস্পরিক আস্থা ও সৌজন্যপূর্ণ পরিবেশ। মোদী সরকার কি তাহা প্রস্তুত করিয়াছে? ভীতিপ্রদর্শন করিয়া, পুলিশি নিগ্রহ করিয়া, রাতারাতি অবস্থানের এলাকাটি ঘিরিয়া আন্দোলনকারীদের দমন-পীড়নের সকল কৌশল লইয়াছে। এমনকি তাঁহাদের ‘খলিস্তানি’ আখ্যা দিয়া ‘দুর্বৃত্ত’, ‘দেশদ্রোহী’ প্রতিপন্ন করিবার চেষ্টাও করিয়াছে। প্রবল শীতে আন্দোলনরত কৃষকরা উঠিয়া যাইবেন, ধান কাটিবার সময় আসিলে ঘরে ফিরিবেন— এমন নানা সম্ভাবনা কল্পনা করিয়া আন্দোলনকে অগ্রাহ্য করিয়াছে। প্রজাতন্ত্র দিবসে কৃষকদের রাজধানীতে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদ মিছিলের পরিকল্পনাকে স্থগিত করিতে সুপ্রিম কোর্টের দ্বারস্থ হইয়াছে সরকার। এই সকল প্রচেষ্টা কৃষকদের মনোবল ভাঙিতে পারে নাই, কিন্তু দেশবাসীকে বুঝাইয়াছে, বিজেপি সরকার পঞ্জাবের কৃষকদের ‘প্রতিপক্ষ’ বলিয়া মনে করে। এই প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়াইয়াছে নির্বাচনী রাজনীতিতেও— আন্দোলনের চুরাশিতম দিবসে পঞ্জাবের পুরনির্বাচনের ফল ঘোষিত হইয়াছে, তাহাতে শোচনীয় পরাজয় হইয়াছে বিজেপির। এই আবহে মত-বিনিময়, বিবিধ শর্ত লইয়া দরদস্তুরের সম্ভাবনা কতটুকু, তাহা সহজেই অনুমেয়। হয়তো করোনা-সঙ্কট তীব্র না হইলে আলোচনার কথাই তুলিত না কেন্দ্র।
আলোচনায় ফলের আশা কম। মূল সমস্যা, কৃষকরা তিনটি আইন বাতিলের দাবিতে অনড়। উপরন্তু তাঁহারা ন্যূনতম সহায়ক মূল্য আবশ্যক করিবার আইন দাবি করিয়াছেন। সরকার তিনটি কৃষি আইন বহাল রাখিবার দাবিতে অনড়, কিছু সংশোধন বড় জোর করিতে পারে। উভয় পক্ষেরই বিবেচনার বিষয় রহিয়াছে। আন্দোলনকারীরা প্রধানত উত্তর-পশ্চিম ভারতের চাষি, তাঁহাদের প্রস্তাবগুলি ভারতের সকল রাজ্যের, সকল শ্রেণির চাষির স্বার্থরক্ষা করিবে কি না, পরিবেশ সুরক্ষা ও সুস্থায়ী চাষের শর্ত পূরণ করিবে কী রূপে, তাহার উত্তর দিতে হইবে। অপর পক্ষে সরকারকেও বুঝিতে হইবে যে, যদি বা কৃষি আইন ‘লাভজনক’ হয়, জোর করিয়া তাহার প্রয়োগ সম্ভব নহে। চাষিকে আগ্রহী হইতে হইবে। চাষির ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করিতে গিয়া তাঁহার বর্তমানকে আরও ঝুঁকিপূর্ণ করিতে চাহিলে তিনি মানিবেন কেন? তাঁহার ঝুঁকি সহনীয় করিয়া আস্থা অর্জন করিবার কাজটিই রাজনীতি।