দাবি আদায় হয়নি, তাই আবার পথে নামছে কৃষক সংগঠনগুলি। ইতিপূর্বে (২০২০-২১) কৃষক আন্দোলনের প্রধান দাবি ছিল তিনটি কৃষি আইনের প্রত্যাহার। এ বার সংযুক্ত কিসান মোর্চা আন্দোলনে নামছে কিছু নির্দিষ্ট দাবি নিয়ে। তার মধ্যে রয়েছে ফসলের ন্যূনতম সহায়ক মূল্যের আইনি নিশ্চয়তা, অন্তত পঞ্চাশ শতাংশ লাভ রেখে সহায়ক মূল্য নির্ধারণ, কৃষি ঋণ মকুব, বিদ্যুৎ সরবরাহ এবং ফসল বিমার ক্ষেত্রে বেসরকারি সংস্থাকে নিষিদ্ধ করা, প্রধানমন্ত্রী ফসল বিমা যোজনা বাতিল, চাষি ও খেতমজুরদের সরকারি পেনশন, ইত্যাদি। সেই সঙ্গে আন্দোলনকারীরা এই দাবিও তুলেছেন যে, বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থা (ডব্লিউটিও)-র চুক্তি থেকে কৃষিকে বিযুক্ত করুক কেন্দ্রীয় সরকার। কারণ, চুক্তিবদ্ধ দেশগুলি চাষিদের কতখানি ভর্তুকি বা অন্যান্য সহায়তা দিতে পারে, তা নির্দিষ্ট— উন্নত দেশগুলির ক্ষেত্রে তা ফসলের বাজারমূল্যের পাঁচ শতাংশ, উন্নয়নশীল দেশগুলিতে দশ শতাংশ। বিশ্ব বাজারে ফসলের দামে যাতে ভারসাম্য থাকে, সেই জন্য এই নিয়ম। ভারতে চাষিদের একাংশ দাবি করছেন, এই চুক্তির ফলে তাঁরা যথেষ্ট সরকারি সহায়তা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। তাই তা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে সরকারকে। গান্ধীজির ‘ভারত ছাড়ো’ আন্দোলনের অনুকরণে ৯ অগস্টকে ‘কর্পোরেট সংস্থা ভারত ছাড়ো’ দিবস হিসাবে পালন করতে চান ওই চাষিরা। ভারতের কৃষিক্ষেত্র থেকে বহুজাতিক সংস্থার অপসারণও তাঁদের অন্যতম দাবি। এ বছর ২৬ ফেব্রুয়ারি ‘ডব্লিউটিও ছাড়ো’ দিবস পালন করেছিল কৃষক সংগঠনগুলির একাংশ, কারণ সে সময়ে বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার বৈঠক চলছিল।
এই দাবিগুলি নিয়ে বিচার করা প্রয়োজন। কয়েকটি প্রশ্ন বড় হয়ে উঠছে। এক, চাষিরা যে পর্যায়ে সরকারি সুরক্ষা চাইছেন, এবং কৃষিকে বেসরকারি বিনিয়োগ থেকে দূরে রাখতে চাইছেন, তাতে চাষ কার্যত একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ক্ষেত্র হয়ে দাঁড়াবে। জমির মালিকানা চাষির, কিন্তু উৎপাদনে ভর্তুকি জোগানো থেকে কৃষকের লাভ ও সামাজিক সুরক্ষা, তার ফসল ক্রয়, মজুত ও বিপণন, সব দায়ই সরকারের। এটা এক দিকে যেমন সরকারের উপর এক দুর্বহ বোঝা, অন্য দিকে তেমনই চাষকে উৎপাদনশীল, লাভজনক করে তোলার উদ্যমের অন্তরায়। দুই, সুস্থায়ী চাষ কৃষিনীতির প্রধান লক্ষ্য হওয়া দরকার। পঞ্জাব-হরিয়ানার চাষি কয়েক প্রজন্ম উৎপাদনে বিপুল ভর্তুকি এবং সরকারি খরিদ থেকে প্রচুর লাভ পেয়েছেন। এতে জল-মাটি-বায়ুর দূষণ বেড়েছে, ফসলের খাদ্যগুণ কমেছে। সুস্থায়ী চাষ, এবং বাজারের চাহিদার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে উৎপাদনে উৎসাহ দিতে হবে সরকারকে। চাষির লাভ সরকারের একমাত্র লক্ষ্য হতে পারে না। তিন, পঞ্জাব-হরিয়ানা ছাড়া অন্যত্র বহুজাতিক সংস্থার সঙ্গে কৃষি ও কৃষি বিপণনের সংযোগ কেমন, তা-ও খতিয়ে দেখা দরকার। কোনও একটি গোষ্ঠীর ব্যবসায়িক স্বার্থ দিয়ে দেশের নীতি নির্ধারণ করা চলে না। কৃষির মতো একটা বিশাল ক্ষেত্র আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের বাইরে থাকবে, এই দাবি কতটা যুক্তিসঙ্গত?
২০২০-২১ সালের কৃষক আন্দোলনের পর তিনটি কৃষি আইন প্রত্যাহার হয়েছে, কিন্তু চাষিদের দাবিগুলির যৌক্তিকতা নিয়ে প্রায় কিছুই আলোচনা হয়নি। রাজনৈতিক বিভাজন রেখা ধরে এর পক্ষে বা বিপক্ষে কথা বলেছে বিভিন্ন দল, নিজেদের মধ্যে বিচার-বিশ্লেষণ করেনি। সংসদ, বিধানসভার শূন্যগর্ভ অধিবেশনের জন্যই বার বার জনপথ রুদ্ধ করে আন্দোলনে নামতে হচ্ছে কৃষক-শ্রমিকদের। গণতন্ত্রে যে কোনও সংগঠিত আন্দোলনই মূল্যবান। ২০২০-২১ সালে কেন্দ্রীয় সরকার যে ভাবে রাষ্ট্রক্ষমতা প্রয়োগ করে কৃষক আন্দোলনকে ভাঙার চেষ্টা করেছিল, সারা বিশ্ব তার নিন্দা করেছিল। আশা করা যায়, তা থেকে শিক্ষা নিয়েছে নরেন্দ্র মোদী সরকার। চাষিকে তাঁর দাবি জানাতে দেওয়া সরকারের প্রথম কর্তব্য। দ্বিতীয় এবং আরও জরুরি কাজ হল, সেই দাবি নিয়ে সর্বস্তরে আলোচনা, সংস্কারের উদ্যোগ ও নয়া নীতি প্রণয়ন।