ফাইল চিত্র।
নরেন্দ্র মোদীর স্বপ্ন, গুজরাতে মহাত্মা গাঁধীর প্রতিষ্ঠিত সাবরমতী আশ্রম হইয়া উঠিবে বিশ্বমানের পর্যটন কেন্দ্র। প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্ন বাস্তব রূপ পাইবে না, তাহা কি হয়? অতএব আশ্রম প্রাঙ্গণে পাঁচ প্রজন্ম ধরিয়া বসবাসরত দুই শতাধিক দলিত পরিবারের কাছে নোটিস গিয়াছে— অন্যত্র উঠিয়া যাইতে হইবে। নিন্দকে বলিবে ‘উচ্ছেদ’, ভক্তরা নিমীলিত চক্ষুতে বলিবেন, ‘পুনর্বাসন’! ঘটনা হইল, একেবারে খালি হাতে তাঁহাদের বিদায় করা হইতেছে না। কিন্তু, সমস্যা টাকার অঙ্কে নহে— মোহনদাস কর্মচন্দ গাঁধীর স্মৃতিকে বিশ্বদরবারে পেশ করিতে হইলে সেই স্মৃতি হইতে ‘হরিজন’-দের নামগন্ধ মুছিয়া ফেলিতে হইবে, এই ভাবনায়।
গত কয় বৎসরে প্রধানমন্ত্রীর নানা স্বপ্ন ও তাহার বাস্তবায়নের চিত্র ভারতবাসী কম দেখে নাই। কালো টাকা নির্মূল করিবার স্বপ্নে অর্থব্যবস্থার কোমর ভাঙিয়াছে। ৩০০০ কোটি টাকার ‘স্ট্যাচু অব ইউনিটি’ বসিয়াছে। অতিমারির বিপুল তরঙ্গভঙ্গে, হাসপাতালের বেড, অক্সিজেন ও টিকার হাহাকারের মধ্যেও দিল্লিতে ‘সেন্ট্রাল ভিস্টা’-র কাজ থামিয়া থাকে নাই, বরং সরকারি নির্দেশে ত্বরান্বিত হইয়াছে। এই সমস্তই নরেন্দ্র মোদীর স্বপ্ন ছিল, সবই বাস্তবে রূপ পাইয়াছে বা পাইতেছে— বিরোধী দল বা নাগরিক সমাজের আপত্তি টিকে নাই। নরেন্দ্র মোদীর শাসনে নাগরিকেরা বুঝিয়া গিয়াছেন, হাতে ক্ষমতা থাকিলে ইচ্ছামতো স্বপ্ন দেখা যায়; প্রশাসন হইতে আইন, পুলিশ, প্রচার— সব ব্যবস্থাই পাশে থাকিবে। এখন কর্তা গাঁধী আশ্রম লইয়া খোয়াব দেখিয়াছেন— সেই আশ্রমকে বাঁচায়, সাধ্য কাহার! গাঁধীর জীবন ও মতাদর্শে তথাকথিত দলিত বা নিম্নবর্ণের জায়গা কী, কেন উহারা প্রজন্মান্তরে আশ্রম প্রাঙ্গণে বাস করিতেছেন, এই সবই গৌণ— ‘স্বপ্নদৃষ্ট’ আন্তর্জাতিক পর্যটন কেন্দ্রের নকশায় তাঁহারা অপ্রয়োজনীয়, ইহাই আসল কথা। আশ্রম চালাইয়া থাকে যে ট্রাস্ট, তাহার সদস্যেরা এখন প্রমাদ গনিতেছেন, নূতন ব্যবস্থায় ট্রাস্ট ও আশ্রমের স্বাধীন সত্তা রক্ষিত হইবে তো? পূর্বে কোনও সরকার ট্রাস্টের পরিচালন-পদ্ধতিতে হস্তক্ষেপ করে নাই। গাঁধীর জন্ম ও প্রয়াণদিনের অনুষ্ঠানে অতিথি হইয়া কে আসিবেন, সেই পছন্দও ‘সরকারি’ হইয়া উঠিবে না তো?
রাজনীতির বিশ্লেষকরা বলিতেছেন আরএসএস-বিজেপির গাঁধী-বিদ্বেষের কথাও। যে দল ও তাহার নিয়ামকেরা নাথুরাম গডসেকে দেশপ্রেমিক আখ্যা দেন, গাঁধীর আদর্শ যাঁহাদের কাছে দুর্বলচিত্তবৃত্তি, তাঁহাদের প্রধান নেতা গাঁধীর আশ্রমকে ‘নবরূপ’ দিতে চাহিলে সন্দেহ হয় বইকি। গর্ব করিবার মতো মনীষীমুখ বিজেপির নাই— এই দিক-ওই দিক হইতে টানিয়া যে দুই-এক জনের ব্যবস্থা হইয়াছিল, তাঁহাদেরও মূর্তি গড়া সম্পূর্ণ। অতএব গাঁধী ও তাঁহার আশ্রম লইয়া টানাটানি— ভাবমূর্তিও প্রলেপ পাইল, কার্যও সমাধা হইল। তবে কিনা, গাঁধীকে গ্রহণ করা তাঁহাদের অসাধ্য— নাগপুরে সেই আধার প্রস্তুত হয় না। সেই কারণেই, গাঁধী আশ্রম হইতে দলিতদের উচ্ছেদ করিবার কথা তাঁহারা ভাবিতে পারেন। গাঁধী তাঁহাদের অন্তরে নাই বলিয়াই। ‘স্বচ্ছ ভারত’ অভিযানে তাঁহারা বাপুর চশমা লইয়াছেন, খাদির ক্যালেন্ডারে প্রধানমন্ত্রী দখল করিয়াছেন চরকাটি। সাবরমতী আশ্রমেও তাঁহারা নামটুকুই লইবেন। গাঁধীর আত্মা— ভারতের আত্মা— তাঁহাদের নাগালে আসিবে না।