Manipur Violence

কোন বার্তা জরুরি

ভারত সরকারের পক্ষ থেকে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানানো হয়েছে। ভারতের বিদেশসচিব জানিয়েছেন, দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে অন্য দেশ এমন মন্তব্য বা প্রস্তাব করতে পারে না।

Advertisement
শেষ আপডেট: ১৭ জুলাই ২০২৩ ০৫:০৯
Share:

মণিপুরে ঘটমান জাতিবৈর এবং সংঘর্ষ নিয়ে একটি কঠোরভাষী প্রস্তাব পাশ করল ইউরোপিয়ান পার্লামেন্ট। —ফাইল চিত্র।

কিছুটা বিস্ময়করই বটে, প্রধানমন্ত্রী মোদী বাস্তিল দিবসের ‘গেস্ট অব অনার’ হিসাবে ফ্রান্সে পা রাখার ঠিক আগেই ইউরোপিয়ান পার্লামেন্ট স্ট্রাসবুর্গের সভায় ভারতের মণিপুর রাজ্যে ঘটমান জাতিবৈর এবং সংঘর্ষ নিয়ে একটি কঠোরভাষী প্রস্তাব পাশ করল। মণিপুরের প্রসঙ্গ উঠল সভার একেবারে শেষ ভাগে— মানবাধিকার, গণতন্ত্র ও আইনের শাসন বিষয়ক আলোচনার সূত্রে। বলা হল, দু’মাসেরও বেশি যে হিংসাকাণ্ড চলছে মণিপুরে, তা গণতান্ত্রিক শাসনের চূড়ান্ত অপারগতা এবং ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উপর মাত্রাছাড়া অত্যাচারের পরিচয় দেয়। ভারত সরকারের পক্ষ থেকে তীব্র প্রতিক্রিয়া জানানো হয়েছে। ভারতের বিদেশসচিব জানিয়েছেন, দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে অন্য দেশ এমন মন্তব্য বা প্রস্তাব করতে পারে না। বিজেপি জাতীয়তাবাদী মর্যাদা ও সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্তের ধুয়ো তুলেছে। এর আগেও ভারতের গণতান্ত্রিক পরিবেশের ক্ষয় এবং সংখ্যালঘু নির্যাতন বিষয়ে বিদেশিদের বলার বা ভাবার এক্তিয়ারের প্রশ্ন একাধিক বার উঠে এসেছে হিন্ডেনবার্গ রিপোর্টের সূত্রে, বা নরেন্দ্র মোদীর সফরকালে আমেরিকান সাংবাদিকের প্রশ্নের সূত্রে, এমনকি বিদেশের মাটিতে রাহুল গান্ধীর বিজেপি-নীতির সমালোচনার সূত্রেও। যুক্তিটি এত দিনে চেনা হয়ে গিয়েছে, কুযুক্তিটিও। কেননা ইতিপূর্বে কাশ্মীরে ভারতীয় সেনার দমননীতি প্রসঙ্গেও রাষ্ট্রপুঞ্জ থেকে শুরু করে অন্যান্য পশ্চিমি দেশের সমালোচনা এই ভাবেই ভারতীয় সরকার প্রতিরোধ করে এসেছে। প্রসঙ্গত, কেবল শাসক বিজেপির তরফ থেকেই আপত্তি ওঠেনি। উঠেছে বিরোধী কংগ্রেসের দিক থেকেও। কয়েক দিন আগে ভারতের আমেরিকার রাষ্ট্রদূত কলকাতায় বার্তা দিয়েছেন যে, মণিপুরের হিংসা অত্যন্ত উদ্বেগজনক, এবং তা থামাতে দরকারে আমেরিকা সহায়তাদানে রাজি। এতে কংগ্রেসের নেতা জয়রাম রমেশ কড়া প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন যে, ভারত নিজের সমস্যা নিজেই সামলাতে সমর্থ, সে প্রধানমন্ত্রী যতই নীরব হোন, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যতই অদক্ষ হোন— অন্য দেশের অকারণ উদ্বেগ বা পদক্ষেপ এ ক্ষেত্রে বাঞ্ছিত নয়।

Advertisement

প্রশ্নটি শেষ পর্যন্ত তবে সার্বভৌমত্বেরই। ভারতীয় রাজনীতিকদের তো বটেই, কূটনীতিকদেরও প্রধান মাথাব্যথা দেশীয় সমাজের কাছে ‘দেশ’-এর মর্যাদারক্ষার বার্তা পৌঁছনো, তাই এই প্রশ্নটিকেই তাঁদের প্রধান করে তুলতে হচ্ছে। তবে কিনা, আন্তর্জাতিক মঞ্চে এহেন প্রস্তাব আকারে উদ্বেগ ঘোষিত হলে তা ঠিক আন্তর্জাতিক রীতি বা নীতি লঙ্ঘন করে না। বিশেষত হিংসাকাণ্ড যে স্তরে গেলে বাইরের দেশ উদ্বেগ করতে পারে, মণিপুর তার থেকে বেশি দূরে নেই। মায়ানমার সীমান্ত-সংযোগের প্রশ্নও আছে বইকি। তা ছাড়া ক্রমবর্ধমান আন্তঃসংযোগময় বিশ্বব্যবস্থায় ভারত যখন সমদর্শী গণতান্ত্রিক দেশ থেকে অর্থনৈতিক, কূটনৈতিক ও সামরিক ক্ষেত্রে সহযোগিতার জন্য সক্রিয় সংগঠনে ব্যাপৃত হয়, এমনকি জি ২০ নেতৃত্বেও উন্নীত হয়— তখন তার অভ্যন্তরীণ গভীর সঙ্কট নিয়ে অন্য দেশ কথা বলবে না, এই ভাবনা অর্থহীন।

তবে একটি অন্য প্রশ্ন উঠবেই ইউরোপীয় পার্লামেন্টের প্রস্তাব বিষয়ে। এই প্রস্তাবে মণিপুর সংঘর্ষের একটি ভুল ছবি তুলে ধরা হয়েছে। মেইতেই-কুকি সংঘর্ষকে প্রধানত ধর্মীয় সংঘর্ষ বলে দেখা যায় না, যদিও মেইতেইরা প্রধানত হিন্দু, এবং কুকি-জ়ো জনজাতিগুলি প্রধানত খ্রিস্টান। সমস্যার উৎসটি ধর্মে নয়, সংখ্যার হিসাবে, ও সংরক্ষণযোগ্যতার দাবিতে। সে দিক থেকে সমস্যাটি ভিন্ন মাত্রার, ভারতীয় গণতন্ত্রের পক্ষে সুদূর বিপদবাহীও বটে। কিন্তু ইউরোপের বিভিন্ন দেশের দক্ষিণপন্থী গোষ্ঠী-অধ্যুষিত সভায় যখন এই ভাবে খ্রিস্টানবিরোধী ধর্মীয় নির্যাতনের ছবিটি তুলে ধরা হয়, তখন তার মধ্যে বর্তমান মণিপুর সঙ্কটকে এক বিভ্রান্তিতে পর্যবসিত করা হয়। ভারত সরকারের উচিত, কেবল জাতীয়তাবাদের ধুয়ো না তুলে বরং এই দিক থেকে বিষয়টি সংযম ও প্রত্যয়ের সঙ্গে আন্তর্জাতিক স্তরে ব্যাখ্যা করা।

Advertisement

আনন্দবাজার অনলাইন এখন

হোয়াট্‌সঅ্যাপেও

ফলো করুন
অন্য মাধ্যমগুলি:
আরও পড়ুন
Advertisement