অগস্ট মাসে, গোটা দেশ যখন আর জি কর-কাণ্ডের বীভৎসতায় স্তম্ভিত, তখন মহারাষ্ট্রের বদলাপুরে একটি স্কুলের এক সাফাইকর্মী গ্রেফতার হয় চার বছর বয়সি দু’টি ছাত্রীকে যৌন হেনস্থা করার অপরাধে। দিনকয়েক আগে পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারাল সে। জানা গেল, অভিযুক্ত যুবক নাকি এক কনস্টেবলের বন্দুক ছিনিয়ে গুলি চালিয়েছিল, ফলে পুলিশ নিরুপায় হয়েই তাকে গুলি করেছে। সত্যি যদি তা-ই হয়, তবু কেন অভিযুক্তের মাথা লক্ষ্য করেই গুলি চালাতে হল, বম্বে হাই কোর্টের এই প্রশ্নের কোনও সন্তোষজনক উত্তর মহারাষ্ট্র পুলিশ দিতে পারেনি। স্বাভাবিক। কারণ, এই গোত্রের এনকাউন্টারের পিছনে পুলিশ যে যুক্তিগুলি সাজায়, তা প্রায় ব্যতিক্রমহীন ভাবে অজুহাত। উত্তরপ্রদেশেও পুলিশের গুলিতে নিহত হল গয়নার দোকানে ডাকাতির ঘটনায় এক অভিযুক্ত। তার সাঙাতও সপ্তাহখানেক আগেই পুলিশের গুলিতে মারা গিয়েছে। তামিলনাড়ুতেও জুলাই মাস থেকে তিন জন অভিযুক্ত নিহত হয়েছে পুলিশের গুলিতে। ঘটনাগুলি কোনও মতেই ‘বিচ্ছিন্ন’ নয়। গত কয়েক বছর ধরেই গোটা দেশ জুড়ে চলছে এনকাউন্টার-রাজ। তাতে অগ্রগণ্য যোগী আদিত্যনাথের নেতৃত্বাধীন উত্তরপ্রদেশ, তবে সে রাজ্য কোনও অর্থেই ব্যতিক্রমী নয়।
এই ভয়ঙ্কর অসাংবিধানিক অভ্যাসটি নিঃসন্দেহে প্রশাসনিক মদতে পুষ্ট। যোগীজির মতো মুখ্যমন্ত্রীরা আছেন, যাঁরা আইন-আদালতের তোয়াক্কা না করেই ‘অভিযুক্ত’-র বাড়ি বুলডোজ়ার দিয়ে গুঁড়িয়ে দিতে পারেন। আছেন অভিষেক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মতো মুকুটহীন সম্রাটরাও, যাঁরা প্রকাশ্যে বলেন, ধর্ষণের মতো ঘটনায় অভিযুক্তদের ‘এনকাউন্টার’ করে মারা উচিত। সন্দেহের যথেষ্ট কারণ আছে, এই হত্যার পিছনে প্রকৃত অপরাধীকে আড়াল করার উদ্দেশ্যও থাকতে পারে। আশঙ্কা হয়, তাতেও ক্ষমতাসীন নেতাদের লাভ। অতীত অভিজ্ঞতা বলছে যে, এনকাউন্টার হত্যার ঘটনায় তদন্ত যদি হয়ও, তার গতি শ্লথ— পুলিশের এই ঠান্ডা মাথায় হত্যার ঘটনার প্রমাণ জোগাড়ের চেয়ে বেশি তাগিদ থাকে সেগুলিকে ধামাচাপা দেওয়ার। ২০১৯ সালে হায়দরাবাদের এনকাউন্টার হত্যায় অভিযুক্ত পুলিশকর্মীদের আদালতে শাস্তি হয়েছে, তা যেমন সত্য— একই রকম সত্য হল, বহু এনকাউন্টারের ঘটনায় তদন্তই শেষ হয়নি। বিরোধী দলগুলিও তেমন ভাবে সরব হয় না এই পুলিশি খুনের ঘটনায়, কারণ তারাও জানে যে, সংবিধানের এই চরম অবমাননার ঘটনাগুলি সাধারণ মানুষের চোখে ন্যায়বিচার হিসাবে প্রতিপন্ন হচ্ছে— অভিযুক্ত পুলিশকর্মীরা নায়কের মর্যাদা পাচ্ছেন। তাতে আপত্তি করা মানে জনতার চোখে ‘অপরাধের সমর্থক’ হয়ে ওঠা।
সাধারণ মানুষ কেন হাতে-গরম ‘বিচার’কেই ন্যায় বলে গণ্য করেন, তার একাধিক কারণ রয়েছে। বিচারবিভাগীয় দীর্ঘসূত্রতা যেমন একটি কারণ, তেমনই অপরাধের রাজনৈতিক বাস্ততন্ত্রও একটি কারণ। মানুষ অভিজ্ঞতায় জানেন যে, অধিকাংশ অপরাধীই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ ভাবে রাজনৈতিক মদতে পুষ্ট— রাজনীতিই তাদের অপরাধের ছাড়পত্র দেয়, রাজনীতিই হয়ে ওঠে তাদের রক্ষাকবচ। সেই রক্ষাকবচ ভেঙে কেউ সেই অপরাধীদের ‘প্রাপ্য সাজা’ দিচ্ছেন, গণমানসে তা একটি ন্যায্যতার বোধের জন্ম দেয়, তা যতই ভ্রান্ত হোক না কেন। মজার কথা হল, যে রাজনীতির বিরুদ্ধে ক্ষোভ শেষ পর্যন্ত এক চরম অন্যায়কেও ন্যায়ের পথ বলে গণ্য করতে মানুষকে বাধ্য করে, সেই রাজনীতিই আবার এই অন্যায়টিকে নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করে। যে পুলিশ এনকাউন্টার হত্যা করছে, তাকে বাহবা দিয়ে, তার চলার পথ মসৃণ করে, অথবা এনকাউন্টারকেই ন্যায়বিধানের প্রকৃষ্ট পথ হিসাবে বর্ণনা করে নেতারা এই অন্যায়ের পিছনে থাকা জনসমর্থনকেও নিজেদের ঘরেই তুলতে চান। নিজেদের বিরুদ্ধে ক্ষোভকেও নিজেদের পুঁজিতে পরিণত করার প্রতিভাটি চমকপ্রদ, সন্দেহ নেই।